প্রতিমা তৈরি করে এবারই সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেয়েছি
নাটোরের রবি সূতম সংঘের পূজামণ্ডপের দেবী দুর্গাসহ সব কটি প্রতিমার অবয়বই ধান দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন বিশ্বজিৎ পাল। পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রতিমাশিল্পীর জীবনের গল্প শুনেছেন মুক্তার হোসেন
সিংড়ার গোবিন্দপুরে আমার দাদাবাড়ি। পূর্বপুরুষেরা সেখানে মৃৎশিল্পের কাজ করতেন। দাদারও ছিল মৃৎশিল্পের ব্যবসা। আমার বাবা নিমাইচন্দ্র পাল দাদার সঙ্গেই কাজ করতেন। বাবার বয়স যখন ১৭, তিনি নাটোরের লালবাজারে চলে আসেন। এখানে আমহাটি গ্রামের প্রতিমাশিল্পী শংকর পালের কাছে কাজ শেখেন। তারপর প্রতিমাশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন ৬০ বছর।
নাটোরের বাড়িতেই আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে প্রতিমা তৈরিতে সহযোগিতা করতাম। তবে স্বর্ণকার হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেছিলাম। একটা জুয়েলারিতে গয়নার ডিজাইন করতাম। একসময় বাবার উৎসাহে প্রতিমা তৈরি শুরু করলাম। ২০ বছর ধরে সেই কাজই করছি।
আমার বাবা ৭৮ বছর বয়সে মারা গেছেন। নাটোরের কোনো কোনো মন্দিরে এখনো বাবার হাতে গড়া প্রতিমা শোভা পাচ্ছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগ পর্যন্ত নাটোর শহরের পুরোনো মন্দিরগুলোতে স্থায়ীভাবে পাথর ও পিতলের প্রতিমা ছিল। যুদ্ধের সময় এসব প্রতিমা ধ্বংস বা লুট হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব মন্দিরের জন্যই স্থায়ীভাবে মাটির প্রতিমা তৈরি করে দেন বাবা।
পূজা-পার্বণে প্রতিমা তৈরির পাশাপাশি সারা বছরই মানুষ ও পশুপাখির প্রতিকৃতি তৈরি করি। প্রতিমা তৈরির কাজে পরিবারের সবাই সবাইকে সহযোগিতা করে। এখনো আমার কাকা গোপালচন্দ্র পাল ও বাবার আমলের কর্মী গোবিন্দচন্দ্র পাল আমার সঙ্গে কাজ করেন। আমার ছেলে অভিজিৎ পালও সহযোগিতা করে। সে–ও আমার মতো এ শিল্পকে ভালোবেসে ফেলেছে। যদিও প্রতিমা তৈরির কাজটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া খুবই কঠিন। আমার ছেলেও জানে। তবু পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে আর দেব-দেবীর আশীর্বাদ পেতে কাজটা করে যাচ্ছি।
এ বছর ধানের প্রতিমা ছাড়াও আরও দুটি দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করেছি। ধানের দুর্গাপ্রতিমা তৈরিতেই সময় লেগেছে বেশি। সারা বছর প্রতিমা ও মূর্তি মিলে এক শর মতো কাজ করতে পারি। এই হিসাবে গত ২০ বছরে অন্তত দুই হাজার প্রতিমা তৈরি করেছি।
শুরুর দিকে একটা দুর্গাপ্রতিমা তৈরিতে মজুরি ছিল পাঁচ শ টাকার কম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মজুরি বেড়েছে। তবে কর্মজীবনের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেয়েছি এবার ধানের দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে। প্রায় লাখ টাকা।
তবে প্রতিমাটি তৈরিতে পরিশ্রমও হয়েছে অনেক। প্রতিবছরই নতুন নতুন উপকরণ দিয়ে ভিন্ন ধাঁচের প্রতিমা বানাতে পছন্দ করি। সবকিছু আসলে গ্রাহকের পছন্দের ওপর নির্ভর করে। এই যেমন ধানের প্রতিমা তৈরির ধারণাটা লালবাজার কদমতলার সূতম সংঘের মণ্ডপ কমিটির চাহিদা থেকে এসেছে। তারা তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। আমি চিন্তা করে কাজে হাত দিয়েছি।
ধান দিয়ে প্রতিমা আমি আগে কোথাও দেখিনি। তবু সাহস করে কাজ শুরু করেছি। প্রায় ৫০ হাজার পাকা ধানের দানা আটটি প্রতিমার শরীরে একটা একটা করে বসিয়ে দেওয়াটা খুবই চ্যালেঞ্জের ছিল। অনেক সময় আর ধৈর্য নিয়ে কাজটি শেষ করেছি। ধান দিয়ে কাজটা করার ফলে অবয়বে নতুন করে রং করার দরকার হয়নি। প্রতিমা থেকে এমনিতেই সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। সোনালি রঙের সঙ্গে মিল রেখে দেব-দেবীর পরিধেয় বস্ত্রের রং নির্ধারণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে অন্য রকম একটা সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে। ভক্ত-দর্শনার্থীরা প্রতিমাটি দেখতে ভিড় করছেন। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই ধানের দুর্গাপ্রতিমা। কাজটি করতে পেরে আমি ও আমার সহযোগীরা ভীষণ খুশি। বাকিটা ভক্ত–দর্শক মূল্যায়ন করবেন।