উইজডেন–এর প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত ময়মনসিংহের এই ছবিটির গল্প জানেন?

ক্রিকেটের বাইবেলখ্যাত উইজডেন–এর বর্ষসেরা ছবির প্রতিযোগিতায় অপেশাদার শাখায় রানারআপ হয়েছে বাংলাদেশের একটি ছবি। ময়মনসিংহে নিজের গ্রামে বেড়াতে গিয়ে ছবিটি তুলেছিলেন আবদুল্লাহ আল মাহফুজ। তাঁর কাছে ছবিটি তোলার গল্প শুনলেন শাহরিয়ার নাজিম

ছবি উইজডেন–এর বর্ষসেরা ছবির প্রতিযোগিতায় অপেশাদার শাখায় রানারআপ হয়েছেছবি: আবদুল্লাহ আল মাহফুজ

গত বছরের এপ্রিলের এমন সময়েই ঈদের ছুটি ছিল। তখন ময়মনসিংহের সুহিলা গ্রামে আমাদের বাড়িতে ছিলাম। সদরের কাছে হওয়ায় গ্রামটা আর আমাদের শৈশবের মতো বৃক্ষশোভিত নেই, চারদিকে বড় বড় ভবন তৈরি হয়েছে। খেলাধুলার তেমন জায়গাও নেই। তবু বাড়িতে থাকলে সামান্য সবুজের খোঁজে গ্রামের এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াই। বড় কোনো গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের সঙ্গে গল্প করি। অভ্যাসবশত মুঠোফোন হাতে নিয়ে ছবিও তুলি।

ঈদের কয়েক দিন পর এমন করেই ঘুরছিলাম। এমন সময় আমার এক ভাতিজা এসে জানাল, সামনের বন্দে (আমাদের গ্রামে খোলা মাঠকে এই নামেই ডাকে) গাছ কাটা হচ্ছে। সম্ভবত পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে জমিটা খালিই পড়ে থাকত। ছোটবেলায় আমরা সেখানে ক্রিকেট খেলতাম। পরে সেখানে অনেক গাছ লাগানো হয়।

গিয়ে দেখি পাঁচ-ছয়জন কিশোর কেটে রাখা গাছের গুঁড়িতে বসে আছে। কারও হাতে ব্যাট, কারও হাতে বল। একদৃষ্টে গাছ কাটা দেখছে সবাই। সবারই মন খারাপ। যে গাছটা কাটা হচ্ছে, তার নিচেই ক্রিকেট খেলত এই কিশোরেরা। খেলার সময় গাছটাকে বানাত স্টাম্প।

আরও পড়ুন
আবদুল্লাহ আল মাহফুজ
ছবি: সংগৃহীত

আমরাও কড়ইগাছটাকে স্টাম্প বানিয়ে দিনের পর দিন ক্রিকেট খেলেছি। দেড় দশকে গাছটা বেশ মোটা হয়ে গেছে। মোটা হওয়ায় গাছের গোড়ায় সাদা স্কচটেপ লাগিয়ে তিনটা স্টাম্প চিহ্নিত করেছে এই ছেলেপুলেরা। স্কচটেপ লাগানোর কারণ সম্ভবত বিতর্ক এড়ানো, গাছের অন্য অংশে বল লাগলে যেন কেউ আউট না দেয়।

মন খারাপ করে বসে থাকা কিশোরদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। শৈশবে কীভাবে আমরা খেলতাম, সেসব স্মৃতিচারণা করলাম। আমার কথা শুনে তাদের মন কিছুটা হালকা হলো। তখনই মুঠোফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলি। ভেবেছিলাম, ছবিগুলো স্মৃতি হিসেবে রাখব।

ছুটি শেষে একসময় ঢাকায় ফিরে আসি। তার আগেই আমার ফেসবুক প্রোফাইলে একটা ছবি পোস্ট করি, যেখানে উসমান নামের এক কিশোর মন খারাপ করে গাছ কাটা দেখছে। তার হাতে ব্যাট-বল। ছবির সঙ্গে ক্যাপশনে আমার মন খারাপের গল্পটাও লিখি।

মুহূর্তেই ছবিটি শেয়ার হতে থাকে। ভাইরাল হতে দেখে আমার ফটোগ্রাফির মেন্টর (সৈয়দ মাহবুবুল কাদের) ইমরান ভাই পরামর্শ দেন ছবিটা সরিয়ে নিতে। সেই সঙ্গে উইজডেন–এর প্রতিযোগিতায় পাঠানোর পরামর্শও দেন। তাঁর তোলা ছবি এর আগে উইজডেন–এ পুরস্কার পেয়েছে।

আরও পড়ুন

সেদিনই সঙ্গে সঙ্গে আমি ছবিটা হাইড করে ফেলি। ছবিটা অন্য যারা শেয়ার করেছিল, তাদের সরিয়ে দিতে অনুরোধ করি। ডিসেম্বরে উইজডেন যখন ছবি আহ্বান করল, তখন সেটা সাবমিট করি।

এরপর অনেক দিন চলে যায়। প্রতিযোগিতার লাখ লাখ ছবির ভিড়ে আমারটা হয়তো নির্বাচিতই হবে না ধরে নিয়েছিলাম। মার্চের শেষে ঈদের ছুটিতে আবার গ্রামে গেলাম। গত বছরের মতো এবারও এদিক–সেদিক ঘুরে ছবি তুললাম। ৩১ মার্চ সেসব ছবি ড্রাইভে রাখার জন্যই মেইলে ঢুকেছিলাম। দেখি বেশ কয়েক দিন আগের উইজডেন–এর একটা মেইল। তারা জানিয়েছে, আমার ছবিটা সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা পেয়েছে। এরপর ৮ এপ্রিল ‘২০২৪ সালের বর্ষসেরা ছবি’র তালিকা প্রকাশ করলে দেখা গেল, আমার ছবিটা অপেশাদার শাখায় যুগ্মভাবে রানারআপ হয়েছে।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি শখের বশে ছবি তুলি। এ কাজে মুঠোফোনই আমার ভরসা। প্রকৃতি, মানুষ, জীবনযাপনসহ নানা বিষয়েই ছবি তোলা হয়। এসব ছবি তুলে বেশ কিছু প্রতিযোগিতা থেকে স্বীকৃতি-সম্মাননাও পেয়েছি। তবে উইজডেন–এর এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে অনন্য। পুরস্কার হিসেবে আমি একটি ক্যামেরাও পাব। তবে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, আমার শৈশবের স্মৃতিময় গাছের গল্পটা অনেকের কাছে পৌঁছে গেল। এবার বাড়িতে গিয়ে উসমানদের সঙ্গে আবার গল্প করতে বসব।

আরও পড়ুন