হতে চেয়েছিলেন ‘যন্ত্রের চিকিৎসক’, হয়েছেন নাসার গবেষক

২০৩২ সালে জিওস্পেস ডাইনামিকস কনস্টেলেশন (জিডিসি) মিশন চালু করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। এ মিশনের গবেষণাকাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশের সাদিয়া মোস্তফা। কুষ্টিয়ার মেয়ে সাদিয়া পড়ালেখার সূত্রে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় আছেন। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তানভীর রহমান

সাদিয়া মোস্তফা
ছবি: সংগৃহীত

পড়ালেখাটা ছোটবেলা থেকেই ভালো লাগত। বাসার বাইরে কম যেতেন, ঘোরাফেরা কম করতেন। সারা দিন মুখ গুঁজে থাকতেন বইয়ে। তখন থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু ক্লাস টেনে ওঠার পর সাদিয়া মোস্তফার মনে হলো, ডাক্তার হওয়াটা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কারণ, কাটাছেঁড়াকে তিনি যমের মতো ভয় পান! তাই সিদ্ধান্ত পাল্টে ঠিক করলেন, মানুষের চিকিৎসা বাদ দিয়ে বরং যন্ত্রের চিকিৎসা করা যাক। সেই থেকে প্রকৌশলের প্রতি ঝোঁক। উচ্চমাধ্যমিকের পর ভর্তি হন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) তড়িৎ ও বৈদ্যুতিক প্রকৌশল (ইইই) বিভাগে। এই বিষয় নির্বাচনের একটা আলাদা কারণ আছে।

আরও পড়ুন

সাদিয়া বলেন, ‘সারা বিশ্ব তড়িৎশক্তির ওপর নির্ভরশীল। আমার মনে হয়েছিল, এই খাতে আমার অবদান রাখার সুযোগ আছে।’

একার লড়াই
২০১০ সাল থেকে নিজের লড়াইটা সাদিয়ার নিজেকেই করতে হয়েছে। বাবা কুষ্টিয়ায় চাকরি করতেন, ছোট ভাইয়ের পড়ালেখাও সেখানে। সব মিলিয়ে পরিবারের পক্ষে সাদিয়াকে সঙ্গ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই কখনো মেসে, কখনো হোস্টেলে থেকেছেন তিনি। ‘একা মেয়ে’ বাড়ির বাইরে থেকে পড়ালেখা করবে, এমনকি উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য দেশের বাইরে যাবে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেটিও অভিভাবকেরা ঠিক মানতে চাননি। সব চ্যালেঞ্জই সামাল দিতে হয়েছে সাদিয়াকে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় পড়তে আসার পর তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে আর্থিক টানাপোড়েন। এ কারণে আইইউবিএটি থেকে বৃত্তি পাওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কোচিং করাতেন তিনি।
২০২০ সালের নভেম্বর থেকে তিনি ভিনদেশি অধ্যাপকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। একাডেমিক জীবনে গবেষণার ক্ষেত্রে কারও কাছ থেকে খুব একটা সহযোগিতা পাননি বলে জানালেন এই তরুণ গবেষক। বলছিলেন, ‘স্নাতক, স্নাতকোত্তরে গবেষণা বিষয়টা কেউই সেভাবে শেখায়নি। দেড় বছর ঘরে বসে নিজে নিজেই শিখেছি। একজন অধ্যাপককে কীভাবে মেইল করতে হয়, সিভি কীভাবে সাজাতে হয়, সব রাস্তা নিজেকেই বের করতে হয়েছে।’ এই পুরোটা সময়ে টিউশন করে নিজের খরচ, বিসিএস প্রস্তুতি ও ডুয়েটে (আইইউবিএটিতে স্নাতক করে এখান থেকেই করেছেন স্নাতকোত্তর) পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন। মাঝখানে ভীষণ হতাশাতেও পড়েছিলেন। প্রকৌশলী হিসেবে ছেলেদের চাকরি হওয়া যতটা সহজ, মেয়েদের ততটা নয়, সেটা বেশ ভালোই টের পেয়েছেন সাদিয়া। একই ব্যাচের অনেক বন্ধু যখন চাকরিতে ঢুকে পড়েছিল, তখনো বেকার সাদিয়া।

বিদেশে পড়ালেখা সুযোগ–সুবিধা, সেই সঙ্গে নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছেগুলো পরিবারকে বোঝাতে প্রায় দেড় বছর লেগে গেছে। সাদিয়া হাল ছাড়েননি। ধৈর্য ধরেই এই চ্যালেঞ্জকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন, পরিবারকে রাজি করিয়েছেন।
বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোভিডও বড় বাধা হয়ে এসেছিল। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মেইল করেছেন। দুই-তিন মাস পর মেইলের জবাব আসছিল, আশ্বাস দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। অবশেষে ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়ার একজন অধ্যাপক জানান, জরুরি ভিত্তিতে তাঁদের একজন গবেষণা সহকারী দরকার। তবে ২০২১–এর মার্চ-এপ্রিল থেকেই শুরু করতে হবে। সাদিয়া তাতেই সায় দেন। প্রথম সেমিস্টার দেশে বসেই করেছেন। ২০২১–এর এপ্রিলে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়।

নাসার সঙ্গে কাজ
ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়াকে বলা হয় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়া। সেখানেই এখন মহাকাশবিজ্ঞান বিভাগে উচ্চতর শিক্ষা নিচ্ছেন সাদিয়া। একাডেমিক কাজের সূত্রেই নাসার উপাত্ত (ডেটা) নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। তাই প্রথম থেকে নাসার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁর একটা ধারণা ছিল। এ ছাড়া নাসাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রতি মাসে সেমিনার করতেন নিয়মিত, বিভিন্ন অধ্যাপকের সঙ্গে সভায়ও থাকতেন। সব মিলিয়ে গত দুই বছর একাডেমিক প্রয়োজনে অনানুষ্ঠানিকভাবে নাসার সঙ্গেই কাজ করেছেন সাদিয়া।
মাসখানেক হলো, নাসা একটি বৈশ্বিক গবেষক দল তৈরি করেছে। ২০৩২ সালে তাদের যে জিওস্পেস ডাইনামিকস কনস্টেলেশন (জিডিসি) মিশন যাত্রা করতে যাচ্ছে, সেটি নিয়েই কাজ করবেন এই দলের সদস্যরা। বিশ্বের নানা প্রান্তের এই গবেষকদের সঙ্গেই এখন কাজ করছেন সাদিয়া। বায়ুমণ্ডলের স্তর আয়োনোস্ফিয়ারের ডিস্টারবেন্সগুলো নিয়ে কাজ করবেন সাদিয়া। স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি নিজ ক্ষেত্রের অধ্যাপকদের সঙ্গেই কাজ করতে চান। পিএইচডি করার ইচ্ছাও আছে। সহজ করে নিজের লক্ষ্যটা বললেন, ‘আমি আসলে শিক্ষার্থীদের পড়াতে চাই। তাদের অনুপ্রাণিত করতে চাই। এগিয়ে দিতে চাই। যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা আমি পেয়েছি, সেটা অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই।’