কুমিল্লার যে কলেজ বদলে দিয়েছে একটি জনপদ
পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠান অনেকটা টাইম মেশিনের মতো। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই হোক না কেন, পুনর্মিলনীর আয়োজনে দেখা যায়, বয়স্ক কিংবা মধ্যবয়স্ক মানুষগুলোর মধ্যেও কেমন শিশুসুলভ চাঞ্চল্য ভর করে। কিছু সময়ের জন্য হলেও সবাই যেন সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যান তাঁরা।
তিতাস নদীর পাড়ে, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার অধ্যাপক আবদুল মজিদ কলেজে ২০ এপ্রিলেও সেই দৃশ্যের দেখা মিলল। ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করা কলেজটি ২৫ পেরিয়েছিল আগেই। তবে করোনার কারণে ধুমধাম করে রজতজয়ন্তী পালন করা হয়নি। দেরিতে হলেও সে আয়োজনের সুবাদে পুরোনো ক্যাম্পাসে ফিরেছিলেন হাজারো শিক্ষার্থী।
সবার চেনা ‘মজিদ কলেজ’
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তো বটেই, সারা দেশেই ‘মজিদ কলেজ’–এর সুনাম আছে। অথচ কলেজটা কুমিল্লা শহর থেকে বেশ দূরে, এখনো গাড়িতে যেতে লেগে যায় প্রায় দুই ঘণ্টা। যখন কলেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই নব্বই দশকে মেঠোপথ দিয়ে যেতে সময় লাগত আরও বেশি। যেখানে দৈনিক পত্রিকা পৌঁছাতেই বেলা গড়িয়ে যেত, সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়াতে ৫ একর জমির ওপর নিজস্ব অর্থায়নে কলেজ করার পরিকল্পনা করেছিলেন অধ্যক্ষ মো. আবদুল মজিদ।
সেরা কলেজের তকমা
১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো মজিদ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেন ৫২৮ জন। সেবারই কুমিল্লা বোর্ডের মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন সাতজন শিক্ষার্থী। এ ঘটনা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ আলোড়ন ফেলেছিল তখন।
এরপর ধারাবাহিকভাবেই এসেছে ভালো ফল। প্রতিষ্ঠার প্রথম ছয় বছরেই কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান করে নেন ৮৬ জন শিক্ষার্থী। জিপিএ পদ্ধতি চালু হওয়ার পরও কলেজের শিক্ষার্থীরা মেধার প্রমাণ দিয়ে এসেছেন। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মো. আবদুল মজিদ বলছিলেন, ‘আজ আমার মনে অনেক আনন্দ। প্রত্যন্ত পল্লিতে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে কলেজ করেছি। আমার ছাত্ররা আজ সরকারের আমলা, বিচারক, পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষক। নামকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ওরা ভালো করছে। এর থেকে বড় আনন্দ আর হতে পারে না। সবাইকে একসঙ্গে একই শামিয়ানার নিচে দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল।’
কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ মো. ফেরদৌস আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘এই কলেজ শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, একটি জনপদকে বদলে দিয়েছে। হাজারো প্রাক্তন রজতজয়ন্তীর আয়োজনে অংশ নিয়েছেন। কলেজের মাঠ-ভবন—সব জায়গায় নিজেদের অতীত জীবনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়েছেন। আমরা সবাইকে দেখে খুব আনন্দিত।’
স্মৃতির টানে
২০ এপ্রিল সকাল থেকেই কলেজ প্রাঙ্গণে ভিড় করেন প্রায় চার হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী। কেউ একা এসেছেন, কেউ সপরিবার। নবীন শিক্ষার্থীরাও অংশ নিয়েছিলেন মিলনমেলায়।
ছুটির ঘণ্টা কি এখনো আগের মতোই বাজে? ক্লাসরুমে কি এখনো চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হয়? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে প্রাক্তনেরা ছুটছিলেন বিভিন্ন ক্লাসরুমে। কৈশোরে ফিরে যাওয়ার গল্প করতে করতে অনেকেরই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল।
কারও কারও একে অপরের সঙ্গে দেখা প্রায় দুই দশক পর। বুকে বুক মিলিয়ে পুরোনো বন্ধনটা ঝালাই করে নিচ্ছিলেন তাঁরা।
সকাল ৯টায় কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বের হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এরপর কলেজ মাঠে জাতীয় সংগীত। কবুতর উড়িয়ে উদ্বোধনের পর একেক ব্যাচের প্রতিনিধিদের অনুভূতি প্রকাশ, রজতজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনির ‘মজিদিয়ান বাতিঘর’–এর মোড়ক উন্মোচন, অতিথিদের বক্তব্য, র্যাফল ড্র ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন চলে প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত।
শেষ আকর্ষণ ছিল জলের গানের পরিবেশনা। জলের গানের সঙ্গে সবাই এক হয়ে গলা মিলিয়ে গেয়েছেন, ‘এমন যদি হতো, আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ।’
পাখির মতো না হলেও ‘উড়ে উড়ে’ সত্যিই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন মজিদিয়ানরা। কলেজের টানে, দেশের টানে এ আয়োজনে এসেছিলেন প্রবাসীদের কেউ কেউ। আবারও দেখা হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে দিন শেষে বাড়ি ফিরেছেন সবাই।