এই ১০ জনের প্রত্যেকের গল্পই আপনাকে অনুপ্রেরণা দেবে
দরিদ্রতম পরিবারের প্রথম মেয়েসন্তান, যাঁরা নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছান, তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে দেওয়া হয় আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া বৃত্তি। চট্টগ্রাম অবস্থিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) শিক্ষার্থীদের এই বৃত্তি দেওয়া হয়। তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি মওকুফসহ নানা সুবিধা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত ট্রান্সকম গ্রুপের সহযোগিতায় ৪২ জন এবং আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহযোগিতায় ৫৬ জনসহ মোট ৯৮ জন এই বৃত্তি পেয়েছেন। ২০২২ সালে বৃত্তিপ্রাপ্ত ১০ জনের গল্প লিখেছেন নাজিম উদ্দিন।
দিনে ১৭০ টাকা আয়ে চলে কুসুমদের পরিবার
কুসুম মুন্ডার বাবা একজন চা–শ্রমিক। দৈনিক আয় ১৭০ টাকা। ৫ সদস্যের পরিবারে বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আয়ের অন্য কোনো উৎসও নেই। তিন বোনের মধ্যে কুসুম বড়, বাকি দুজনও পড়াশোনা করছে। কুসুম বলেন, ‘যেভাবে হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বই—এই লক্ষ্য আমার সব সময়ই ছিল। যখন এইউডব্লিউর কথা জানতে পারি, তখন ভালোভাবে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিই। অবশেষে সুযোগও পেয়ে যাই। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে একজন আদর্শ মানুষ হতে চাই। বিসিএস ক্যাডার হয়ে শিক্ষকতা করার ইচ্ছা আছে।’ কুসুম মনে করেন, অদ্বিতীয়া বৃত্তি তাঁর পড়ালেখার পথ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। কুসুম বলছিলেন, ‘বাবার ওপর চাপ কমেছে, এটাই বড় স্বস্তির বিষয়। আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
মায়ের সঙ্গে স্মৃতিও তুলতেন চা–পাতা
সিলেটের মালনীছড়া চা–বাগানের মেয়ে স্মৃতি রানী মুদি। বাবা হৃদেশ মুদি চা শ্রমিক ইউনিয়নের আওতাধীন একজন শিক্ষক। মা মিতা সিং রাউতিয়া একজন চা–শ্রমিক। মালনীছড়া চা–বাগানের মেয়েদের মধ্যে স্মৃতিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পা রেখেছেন। অন্য মেয়েদের অনুপ্রেরণা হতে চান তিনি। এইউডব্লিউর এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের দুই বোনের পড়ালেখা চালাতে অমানবিক পরিশ্রম করেন মা-বাবা। ঋণও করতে হয়েছে। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আমি আর আমার বোন চা–পাতা তোলার কাজে মাকে সাহায্য করতাম। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল বলেই কড়া রোদে চা–পাতা তোলার কাজও কখনো কষ্টের মনে হয়নি। আমি বিসিএস দিয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হতে চাই। পাশাপাশি ফটোগ্রাফি ও ছবি আঁকার আগ্রহও আছে। আমি চাই চা–বাগানের মেয়েদের স্বপ্ন দেখাতে, তাঁদের অনুপ্রেরণা হতে।’
সুযোগ কাজে লাগাতে জানেন নাঈমা
কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক করে এইউডব্লিউতে ভর্তির সুযোগ নেন জান্নাতুল নাঈমা। ২০১৬ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েছিলেন নাঈমার মা। উপায়ান্তর না পেয়ে ডিগ্রি পড়ার সময় সংসার চালানোর জন্য একটি দোকানে কাজ নেন ভাই। নাঈমাদের পরিবারের অভাব অনটন দেখে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়াতে সম্মত হয়েছিলেন কয়েকজন শিক্ষক। সুযোগটা বৃথা যেতে দেননি এই মেধাবী ছাত্রী। পরিবারের প্রথম মেয়ে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। জান্নাতুল নাঈমা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য আমার পরিবারের ছিল না। এখন যেহেতু সুযোগটা পেয়েছি, তাই এই সুযোগে সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করব। ইচ্ছা আছে, পড়ালেখা শেষ করে আমাদের গ্রামের কলেজে শিক্ষকতা করব। পাশাপাশি নারীশিক্ষার উন্নয়নের জন্য কাজ করব।’
ছয় কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতেন দীপা
দীপা সিংয়ের বাবা গজেন সিং মিরতিংগা চা–বাগানের একজন শ্রমিক। মা সমিতা সিং গৃহিণী। প্রতিদিন ছয় কিলোমিটার হেঁটে দীপাকে স্কুলে যেতে হতো। অনেক কষ্টে কলেজ পেরিয়েছেন। কিন্তু তারপর? বাবা বলে দিয়েছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য তো আমার নাই মা।’ কোচিং করার খরচই–বা কে দেবে? এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পুরোনো বই সংগ্রহ করে ভর্তির প্রস্তুতি নেন দীপা। তিনি বলছিলেন, ‘সবাই বাবা-মাকে বলত, মেয়েদের এত পড়াশোনা করানো ঠিক না, বিয়ে দিয়ে দাও। মা-বাবাও সে রকমই ভাবছিলেন। কিন্তু আমি একরকম যুদ্ধ করেই ভর্তি পরীক্ষা দিই। প্রথমবার সুযোগ হয়নি। পরের বছর আবার পরীক্ষা দিয়ে এইউডব্লিউতে সুযোগ পাই। বৃত্তি পেয়ে আমার মনোবল বেড়ে যায়। এখন আমার একটাই লক্ষ্য—ভালোভাবে পড়াশোনা করে চা–বাগানের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের নিয়ে কাজ করা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, এ কথা বলার সাহসটাও ছিল না
চা–শ্রমিকের সন্তান—এই পরিচয় নিয়ে গর্ব করেন স্মৃতি সিসিলিয়া কেরকেটা। যে পরিবেশে বড় হয়েছেন, সেখানে মেয়েদের শিক্ষার চল নেই বললেই চলে। তবু তিনি ভাগ্যবান, পড়ালেখার ক্ষেত্রে মা-বাবাকে পাশে পেয়েছেন সব সময়। সমর্থন থাকলে কী হবে, সামর্থ্য তাঁদের ছিল না। টাকার অভাবে উচ্চমাধ্যমিকের সব বইও কিনতে পারেননি। করোনাকালে স্মার্টফোনের অভাবে করতে পারেননি অনলাইন ক্লাস। এত বাধার পরও এইচএসসিতে পেয়েছেন জিপিএ ৪.৯২। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন, এসব কথা বলার সাহসটাও তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। নিজের চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এইউডব্লিউতে ভর্তি পরীক্ষা দেন। এইউডব্লিউতে সুযোগ হয়ে যাওয়ার পর মনে সাহস পান। স্মৃতি বলেন, ‘অদ্বিতীয়া বৃত্তিটা আমার খুব প্রয়োজন ছিল। এখন আমি অনেকটা নির্ভার। নিজের খরচ অন্তত চালাতে পারব। শুধু পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারব।’
গার্মেন্টে ১৭ মাস চাকরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে
গাইবান্ধার সাদুল্ল্যাপুর উপজেলার মেয়ে ইসমা আক্তর। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। এই দিন দেখার জন্য রিকশাচালক বাবা আর গৃহকর্মী মাকে কত কষ্টই না করতে হয়েছে! ইসমা বলেন, ‘অন্যের বাসায় কাজ করে আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন আমার মা। যাঁর বাসায় কাজ করতেন, তিনি অনেক সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার পর বড় সংকটে পড়ে আমার পরিবার। বাবার পক্ষে রিকশা চালিয়ে পরিবারের ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে আমি গার্মেন্টে চাকরি শুরু করি। প্রায় ১৭ মাস চাকরি করেছি। কিন্তু মা যে বাসায় কাজ করেন, সেই বাসার নানু সব সময় আমাকে আরও পড়ানোর কথা বলতেন। তাঁর উৎসাহেই মা-বাবা রাজি হন। নানুর পরামর্শে আমি এইউডব্লিউর খোঁজখবর নিই। পরীক্ষা দিয়ে টিকে যাই। আমার পরিবারের আমিই স্নাতক পড়া প্রথম মেয়ে। এই অনুভূতি অন্যরকম।’
‘ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিল’
উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হতে পেরেই প্রতিমা লোহারের মনে হয়েছিল, স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে। চা–শ্রমিকের সন্তান, কলেজে পড়বেন, এ স্বপ্ন দেখতেই তাঁকে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা তো রীতিমতো দুঃসাহস। কলেজে যাওয়া-আসার ভাড়া জোগাতে কষ্ট হতো বলে প্রতিদিন ক্লাস করতে পারেননি। তবু অনেক কষ্টে এইচএসসি পেরিয়েছেন। কিন্তু এরপরই শুরু হয় বিয়ের জন্য চাপ। প্রতিমা বলেন, ‘একদিন ছেলেপক্ষ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাকে দেখতে আসে। সেই সময়টা ছিল সবচেয়ে কঠিন। পরিবারের ইচ্ছা ছিল শ্বশুরবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করব। কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না। একরকম লড়াই করে এইউডব্লিউতে ভর্তি হয়েছি।’ প্রবল ইচ্ছাশক্তিই নানা বাধা পেরিয়ে প্রতিমাকে এতদূর আসতে সাহায্য করেছে। পড়ালেখা করে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে চান তিনি।
কে বলে শুধু ছেলেরাই মা-বাবার দায়িত্ব নিতে পারে?
‘আমি কালিটি চা–বাগানের সন্তান। যেখানে বড় হয়েছি, সেখানে মেয়েদের পড়ালেখা তো দূরে থাক, অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই নিয়ম। এখানে সবার ধারণা, ছেলেরাই মা-বাবাকে সারা জীবন দেখবে। একটা মেয়েও যে মা-বাবার দায়িত্ব নিতে পারে, তাঁরা জানেন না। আমি এটা প্রমাণ করব,’ কথাগুলো তিলোতমা রজকের। তিনি এখন এইউডব্লিউতে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে তিলোতমা খুশি হলেও আশপাশের মানুষ খুশি হতে পারেননি। সবাই বলেছেন, মেয়েমানুষ, এত পড়াশোনা করিয়ে কী লাভ? শেষ পর্যন্ত পরের বাড়িতে সংসার করে খেতে হবে। এসব কথায় কান দেয়নি তাঁর পরিবার। অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া তিলোতমা জানান, তাঁর জীবনের লক্ষ্য এখন দুটি—মা, বাবা ও পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া এবং তাঁর সম্প্রদায়ের মেয়েদের জন্য কাজ করা।
মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চান অথই
চট্টগ্রামের মেয়ে অথই ধর। খুব ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন, স্ত্রী, সংসার ও ছেলেমেয়ের প্রতি খুবই উদাসীন তাঁর বাবা। অথইয়ের বয়স যখন ৮, তাদের ফেলে চলে যান তাঁর বাবা। আর কোনো যোগাযোগ রাখেননি। এরপর জায়গা হয় মামাবাড়ি। মামা এবং মেসোর সহায়তায় কোনোভাবে জীবন কাটিয়েছেন তাঁরা। আর্থিক সমস্যার কারণে পড়াশোনার জন্য কোচিং বা টিউটরের তেমন সুবিধা পাননি। এ পর্যন্ত যা কিছু অর্জন, সবটুকুই নিজের চেষ্টায়। অথই এখন এইউডব্লিউতে প্রথম বর্ষে পড়ছেন। সফল মানুষ হয়ে একদিন মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবেন, দুঃখ ঘোচাবেন—এই তাঁর ইচ্ছা। অথই বলেন, ‘এইউডব্লিউ আমার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ করে দিয়েছে। আর অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি আমাকে আরও উদ্দীপ্ত করেছে, সাহস দিয়েছে। পড়াশোনায় এখন আমি আরও ভালোভাবে মনোযোগ দিতে পারব।’
ঋণ করে বিউটিকে স্কুলে পড়িয়েছেন বাবা
দুই ভাইবোনের মধ্যে বিউটি সরকার বড়। মা গৃহিণী, বাবা গ্রামের বাজারে স্বর্ণকারের কাজ করেন। বিউটি বলেন, ‘যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। একসময় যখন আলাদা থাকা শুরু করলাম, তখন পড়লাম আর্থিক অনটনে। বাবার দোকান যেহেতু গ্রামে, তাই খুব একটা আয় নেই। ছোটবেলায় নিজে পড়ালেখার সুযোগ পাননি বলে সাধ্যমতো আমাদের পড়ানোর চেষ্টা করেছেন বাবা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমাকে ভারতেশ্বরী হোমসে ভর্তি করেন। সেখানকার পড়ালেখা বেশ ব্যয়বহুল। এইচএসসি শেষ হওয়ার পর একপ্রকার বাধ্য হয়েই তিনি আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু আমার পড়ার ইচ্ছা ছিল প্রবল। এইউডব্লিউতে ভর্তি হতে পারা আমার জীবনের বড় অর্জন।’ অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি বিউটিকে সাহস জুগিয়েছে। সমাজের অবহেলিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর এবং বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।