পর্নোগ্রাফিতে কেন মানুষের এত আসক্তি?
খুলনার এক তরুণকে গ্রেপ্তারের পর নতুন করে আলোচনায় পর্নোগ্রাফি আর নগ্নছবির আসক্তি। অনলাইনে যুক্তরাষ্ট্রের এক কিশোরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে কৌশলে কিশোরীর নগ্ন ছবি তুলে নিতেন ওই তরুণ। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা ২১ আগস্ট তাঁর বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁর ল্যাপটপে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার আরও ৩০ কিশোরী এবং তরুণীর পর্নো ছবি পাওয়া যায়। আটক হওয়ার পর এই তরুণ জানিয়েছেন, তিনি শুধুই নিজের শখ থেকে এসব ছবি সংগ্রহ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক ও পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটের আয়ের হিসাব বলছে, ২০২২ সালে এই সেক্টরের বাজার ছিল ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত পাঁচ বছরে এই বাজার সেখানে গড়ে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়ছে।
২০১৯ সালে গোটা ব্রিটেনে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের ওপর পরিচালিত একটি জরিপ থেকে জানা যায়, ৭৭ শতাংশ পুরুষ ও ৪৭ শতাংশ নারী জরিপে অংশ নেওয়ার আগের মাসেও পর্নো দেখেছেন। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের কাছ থেকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে, সেটা হলো—অধিকাংশ তরুণই মনে করেন বাস্তব জীবনের সঙ্গে পর্নোছবিতে দেখানো যৌনতার কোনো মিল নেই।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, তারপরও বিশ্বব্যাপী কেন মানুষ পর্নোতে আসক্ত হয়? জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল বলেন, ‘নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি সব সময়ই মানুষের আকর্ষণ থাকে। পর্নোগ্রাফিও তা–ই। পর্নো দেখার সময় মস্তিষ্কে ডোপামিন ও এন্ডোরফিন নিঃসরণ হয়, যা এক ধরনের তাৎক্ষণিক উদ্দীপনা তৈরি করে। এ কারণে মস্তিষ্কে সাময়িক এক ধরনের ভালো লাগা তৈরি হয়।’ এই ভালো লাগা থেকেই মানুষ বারবার নগ্নতা বা পর্নোগ্রাফির মতো বিষয়ে আসক্ত হয়। মানসিক স্থাস্থ্যের এই সহযোগী অধ্যাপক মনে করেন, যৌনশিক্ষার (সেক্স এডুকেশন) সঠিক জ্ঞান না থাকলে মানুষ এ ধরনের আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে। এক ধরনের ফ্যান্টাসি থেকে অন্যের মতো হতে চায়।
যৌনতা নিয়ে কম আলোচনা, হস্তমৈথুন নিয়ে ট্যাবু, ভুল শিক্ষার মতো কারণগুলোও মানুষকে পর্নোগ্রাফি ও ছবিতে আসক্ত করার পথে নিয়ে যায়।
আসক্তি থেকে ফেরার উপায়
২০১৯ সালে ব্রিটেনের ওই জরিপের পর তরুণদের পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি কমাতে নানা পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যৌনস্বাস্থ্যবিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ এবং ইনস্টিটিউট অব সাইকোসেক্সুয়াল মেডিসিনের সদস্য ড. কেট হাওয়েলস বলেন, ‘পর্নোগ্রাফির ব্যাপারে প্রশ্ন করতে গিয়ে ভয় পেলে চলবে না। তারা কী দেখে, কতটুকু দেখে এবং কখন দেখে—এসব জানা দরকার। এ বিষয়ে আমাদের অনেক শিক্ষার প্রয়োজন, বিশেষ করে যৌনশিক্ষা। আর যৌনশিক্ষার মধ্যে পর্নোগ্রাফিকেও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। সম্পর্ক কিংবা নারী ও পুরুষের ক্ষমতায়নের ওপর এর কী ধরনের প্রভাব পড়ে, এসব বিষয়ে জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ ২০২২ সাল থেকে ওয়েলসের পাঠ্যসূচিতে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলেও ধরা হচ্ছে।
নগ্ন ভিডিও এবং ছবি দেখা যখন আসক্তিতে পরিণত হয়, তখন মানুষের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। তাই আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল এই অবস্থা থেকে উত্তরণের বেশ কয়েকটি উপায়ের কথা বলেছেন। তা হলো—
যেকোনো দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক যৌনশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
পর্নো আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে বিকল্প আনন্দের উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
যিনি এত দিন নগ্ন ছবি বা ভিডিও দেখে নিজেকে আনন্দে রাখতেন, তিনি সংগীত, সিনেমা, শরীরচর্চার মতো বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিতে পারেন। এসব বিষয়ে যদি নিজেকে আনন্দে রাখতে পারেন, তাহলে সহজে পর্নোগ্রাফি আসক্তি কেটে যাবে।
পর্নোগ্রাফির সাইট বন্ধ করে হয়তো সাময়িক সুবিধা মিলবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে চাইলে এসব সাইট শুধু বন্ধ না করে এর চাহিদা কমাতে হবে।
নৈতিকতার চর্চা বা ধর্মীয় চর্চাও পর্নোগ্রাফি থেকে বিরত রাখতে কার্যকর, তবে সেটাও সাময়িক।
যৌনশিক্ষা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, ততই মানুষ সঠিক দিকগুলো জানতে পারবে। আর এভাবেই কমে আসবে আসক্তি।
যে তরুণকে খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁর বয়স ২০ বছর। রাজশাহীর একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ক্লাস করেন না। সম্প্রতি বাসায় থেকেই বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ওই তরুণের বাবা–মা তাঁকে বাইরে কোথাও যেতে দিতেন না। একাকিত্ব থেকে তাঁর মুঠোফোনে আসক্তি তৈরি হয়। আস্তে আস্তে নিষিদ্ধ ওই জগতে ঢুকে পড়েন ওই তরুণ।
তথ্যসূত্র: বিবিসি ও ফোর্বস