বিষণ্নতায় মোড়া গণিতের বড় আয়োজনে বাংলাদেশের অর্জন দুটি ব্রোঞ্জ

মঞ্চে বাংলাদেশ দল। এইচএসসি পরীক্ষা থাকায় নাহিয়ান তখনও লন্ডনে উপস্থিত হতে পারেনি। পরে সে দলের সঙ্গে যোগ দেয়

‘এখনকার পৃথিবী অন্য সময়ের চেয়ে অনেক কঠিন, অনেক জায়গায় অনেক রকমের মন খারাপের ঘটনা ঘটছে। সারা বিশ্বে অনেক রকম উত্তেজনা চলছে। সবকিছু দূরে রেখে গণিতের জন্য আগামী এক সপ্তাহ ছেলেমেয়েরা কাজ করবে, এটাই আমাদের আনন্দ।’ এই বার্তা দিয়েই আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের (আইএমও) উদ্বোধন করেছিলেন অধ্যাপক জিওফ স্মিথ। ৬৫তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজক কমিটির তিনি চেয়ারম্যান।

এবারের আয়োজনটি ইউক্রেনে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সেখানে এটি করা সম্ভব হয়নি। তখন এই গুরুদায়িত্ব নিতে রাজি হয় যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বাথ। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।

যুক্তরাজ্যের বাথ শহরের ‘দ্য ফোরাম’ হলে আইএমওর উদ্বোধন হয় ১৫ জুলাই। এ নিয়ে চারবার আইএমওর আয়োজন করল যুক্তরাজ্য। এর আগে ১৯৭৯ সালে লন্ডনে, ২০০২ সালে গ্লাসগোতে এবং ২০১৯ সালে বাথ শহরে এই আয়োজন হয়। এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছে প্রায় ১১০ দেশের ৬ শতাধিক খুদে গণিতবিদ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বিভিন্ন দেশের খুদে গণিতবিদদের বর্ণাঢ্য প্যারেড। পতাকা তো সঙ্গে থাকেই, পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে নিজ দেশের সংস্কৃতি ও পরিচয় তুলে ধরে শিক্ষার্থীরা। তাদের পরনে থাকে যার যার দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। লাল-সবুজ টি–শার্ট পরে বাংলাদেশ দলের সদস্যরা যেমন একটি বেঙ্গল টাইগারের মাসকট নিয়ে মঞ্চে ওঠে।

সব দলই মঞ্চে ওঠার পর তালি পড়ে। তবে সবচেয়ে দীর্ঘ ও প্রাণবন্ত করতালিটা বোধ হয় ইউক্রেন দল পেয়েছে। কারণ, যুদ্ধের মধ্যেও তারা এত বড় আয়োজনে অংশ নিয়েছে, গণিতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এ ছাড়া বিশেষভাবে বলতে হয় ফিলিস্তিনের গণিত দলের কথা। সেখানেও যুদ্ধ চলছে। ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ পাসপোর্ট আটকে দেওয়ায় দলের সব সদস্য অলিম্পিয়াডে হাজির হতে পারেনি। প্রতিনিধি হিসেবে এসেছে দলনেতা ও উপদলনেতা।

আয়োজনটি যেহেতু ইউক্রেনে হওয়ার কথা ছিল, তাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে রাখা হয়েছিল ইউক্রেনের লোকগান ও নাচ।

পরীক্ষা পর্ব

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের নিয়ম অনুযায়ী একেকটি দলে সদস্য থাকে ছয়জন। এ বছর বাংলাদেশ দলের সদস্যরা হলো মনামী জামান (ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ), এস এম এ নাহিয়ান (ঢাকা কলেজ), জিতেন্দ্র বড়ুয়া (চট্টগ্রাম বাকলিয়া সরকারি কলেজ), তাহসিন খান (ময়মনসিংহ জিলা স্কুল), নাফিজ নূর (বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ) ও মুসাহিদ আহমদ (বরিশাল ক্যাডেট কলেজ)।

দলনেতা ও কোচ অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার আগেই অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া উপদলনেতা হিসেবে আইএমও দলের মেন্টর মির্জা মো. তানজিম শরীফ ও পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি মুনির হাসানও দলের সঙ্গে আছি।

১৬ ও ১৭ জুলাই ইউনিভার্সিটি অব বাথের এজ সেন্টারে আমাদের শিক্ষার্থীদের দল যখন পরীক্ষা দিচ্ছিল, তারা তখনো জানত না দেশে তাদের বন্ধুদের অনেকেই রাজপথে আন্দোলন করছে।

নিয়ম অনুযায়ী ২ দিনে ৯ ঘণ্টার পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে। বিভিন্ন দেশের দলনেতা ও উপদল নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর প্রশ্ন একটু কঠিন ছিল। সারা বিশ্বের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের ছেলেমেয়েরাও জ্যামিতি, নম্বর থিওরি, কম্বিনেটরিকস ও বীজগণিত—এই চার বিষয়ের ছয়টি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে।

পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ১৮ জুলাই তারা অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উইন্ডসর দুর্গ ও বাকিংহাম প্যালেস ঘুরে আসে। পরদিন সকাল থেকে তারা লন্ডন টাওয়ারসহ লন্ডনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য বাথের সুন্দর ক্যাম্পাসজুড়ে ফুটবলসহ নানা খেলাধুলার আয়োজন ছিল। এই সময়টাতে বিভিন্ন দেশের দলনেতা ও উপদল নেতারা মূলত শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজ করেছেন।

এ বছর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে এই ৬ শিক্ষার্থী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

অনুপ্রেরণা

এ বছর ওমানের গণিত দলের ছয় সদস্যই ছিল নারী। দলটির দলনেতার সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, তাঁদের দেশে সব সময় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফল ভালো। এ নিয়ে চতুর্থবার তারা অলিম্পিয়াডে অংশ নিল। প্রতিবারই মেয়েদের সংখ্যা ছিল বেশি। সামগ্রিকভাবেও এবার অবশ্য মেয়েদের উপস্থিতি আগের তুলনায় বেশি বলে মনে হলো।

ভিসা জটিলতায় তিনটি দেশ এবার অংশ নিতে পারেনি। মরক্কো, ক্যামেরুন ও কম্বোডিয়া। এ বছর অনেক দেশ থেকেই প্রতিযোগী ছিল মাত্র একজন। যেমন নিকারাগুয়া, পানামা, হন্ডুরাস।

এ বছর ২০২৮ সালের আয়োজক দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সৌদি আরবের নাম। অস্ট্রেলিয়া ও হাঙ্গেরিতে বসবে এর আগের দুটি আন্তর্জাতিক আসর।

বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপের সময় একটা বিষয় উঠে এল। সবাই-ই বলছেন, করোনা–পরবর্তী সময়ে গণিতপ্রেমী এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের আচরণগত ও প্রস্তুতিগত পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি ডিভাইসনির্ভর হয়ে গেছে। প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়েছে অনেক দেশ। যদিও বেশির ভাগ দেশই যন্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে সরাসরি প্রশিক্ষণে ফিরে আসার চেষ্টা করছে।

আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। অন্যবারের তুলনায় এবার সারা পৃথিবীর অভিভাবকদেরই উৎকণ্ঠা অনেক বেশি মনে হলো। সব দেশের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরাই বারবার ফোন করছেন, খোঁজ নিচ্ছেন। আগে কখনোই এমনটা চোখে পড়েনি। বিভিন্ন দলের দলনেতা-উপদলনেতারাও এ ব্যাপারে একমত হলেন। এটি আসলে বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তাহীনতা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠারই বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশের ফল

এ বছর বাংলাদেশের ঝুলিতে যোগ হয়েছে দুটি ব্রোঞ্জ পদক। পেয়েছে মনামী জামান ও এস এম এ নাহিয়ান।

২০তম বারের মতো আইএমওতে অংশ নিল বাংলাদেশ। গত ১৯ বছরে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা জিতেছে ১টি স্বর্ণ, ৭টি রৌপ্য, ৩৫টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৪৩টি পদক আর ৪০টি সম্মাননা স্বীকৃতি।

জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যেন গণিতকে ভয় না করে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে, সে লক্ষ্যেই প্রতিবছর প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব’। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি দেশব্যাপী গণিত উৎসব আয়োজন করে। এবারের আয়োজনে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের মূল দলে জায়গা করে নিতে লড়েছিল সারা দেশের প্রায় ৭১ হাজার শিক্ষার্থী। অনলাইনে প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার পর উত্তীর্ণদের নিয়ে ১৮টি শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা। সেখান থেকে ১ হাজার ৩৫০ জন আঞ্চলিক বিজয়ীকে নিয়ে ঢাকায় হয়েছে জাতীয় উৎসব। বিজয়ী ৮৫ জনকে নিয়ে বাছাই পরীক্ষার পর উত্তীর্ণ ৪০ জনকে নিয়ে শুরু হয় গণিত অলিম্পিয়াড ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে ধাপে ধাপে এশিয়ান-প্যাসিফিক গণিত অলিম্পিয়াড ও আইএমও নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সেরা ছয়জনকে নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াডের মূল দল গঠন করা হয়েছে।

লেখক: গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের সমন্বয়ক