পাকিস্তানি এক সেনা ডেকে বলেছিল, ‘ঈদ মোবারক নেহি বোলগে?’
১৯৭১ সালেও এসেছিল ঈদ। যুদ্ধের মধ্যেই শেষ দিকে পবিত্র রমজান মাস পেরিয়ে ঈদের চাঁদ ওঠে। চারদিকে মৃত্যু, ভয়, আতঙ্কের সেই সময়ে কেমন কেটেছিল ঈদ? তা–ই জানার চেষ্টা করেছি আমরা। স্বাধীনতা দিবসে সেই স্মৃতির কথা পড়ুন এখানে।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার আল্লাই কাগজিপাড়া গ্রামে ছিল আমাদের বাড়ি। বোমা পড়ার ভয়ে স্কুল বন্ধ ছিল আমাদের। লোকজন বলাবলি করছিল, আর লেখাপড়া হবে না। আমি তাই বাড়ির পাশে সাবান, চুড়ি, ফিতা এসব নিয়ে বসতাম। যদি বিক্রি হয়, কিছু টাকা আসবে, সংসারের কাজে লাগবে। রোজার মাসে একদিন সদর থেকে ১৯৩৭ সাবানসহ কিছু জিনিস নিয়ে কাগজিপাড়ায় যাচ্ছি। পথে সেনারা গতি রোধ করল। তল্লাশি করে বের হলো গোল বল সাবান। এই সাবানটি হয়তো চিনতে পারেনি সেনারা। তাই পথে আরেকজনকে ডেকে নিশ্চিত হলো, এটা সাবান। ১৯৭১ সালে পবিত্র রমজান মাসের একটি দিনের ঘটনা এটি। এমন ভয় ধরানো অস্বস্তিকর পরিবেশে সেবার ঈদ উৎসবের লেশমাত্র ছিল না।
১৯৬১ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা তিন ভাই ছিলাম মায়ের সঙ্গে। বড় ভাই জাহেদুল হক বন্দরে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে বেশির ভাগ সময় চট্টগ্রামে থাকতেন তিনি। বাড়িতে তখন আমি, মেজ ভাই আমিনুল হক আর আমার মা নুর খাতুন ছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল আমার মেজ ভাই পাকিস্তানিদের বিমান হামলায় মারা যান। মাত্র ২৫ বছর বয়স ছিল তাঁর। এ ঘটনার পর আমাদের পরিবারে স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যায়। আম্মা আমাকে আর ভাইদের নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকতেন।
একাত্তরের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে রোজা শুরু হয়। আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। পড়ি রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয়ে। রোজার মাসে ঘরে বসেই দিন কাটছিল আমার। বড় ভাই বন্দরের কর্মকর্তা, সপ্তাহে দুই–তিনবার বাড়িতে আসতেন। আসার সময় বাজার নিয়ে আসতেন। রোজায় তাঁর আনা ছোলা, চিড়া খেতাম আমরা। কখনো কখনো কলা পেতাম। আর সাহ্রিতে দুধভাত।
সে সময় তারাবিহর নামাজ পড়তে গেলে দেখতাম বাড়তি কোনো আলাপ নেই। দু–একটা ফিসফাস শুনতাম। লোকে মনখুলে কথা বলতে ভয় পেত। কেবল কর্তব্য পালন করতে হবে, তাই বাধ্য হয়ে মসজিদে এসেছিলেন অনেকে। এভাবেই রোজা শেষ হয়ে ঈদ এল। সেবার পবিত্র ঈদুল ফিতর ছিল ২০ নভেম্বর। পটিয়ায় মূল জামাত হয় রাহাত আলী স্কুলের মাঠে। পরিস্থিতির কারণে আমরা এত দূরে যাইনি। বাড়ির পাশের আমান আলী চৌধুরী মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েছি। বড় ভাই জাহেদুল হকের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। পরনে ছিল পুরোনো কালো রঙের জামা আর জিন্নাহ টুপি। ঈদ উপলক্ষে নতুন পাঞ্জাবি কেনা হয়নি, তাই ওই জামা পরেই ঈদগাহে যাই।
বাড়িতে সেদিন দুধের সেমাই আর চুটকি পিঠা রান্না হয়েছিল। ঈদের বিশেষ খাবার বলতে এটুকুই। সকালে ঈদের নামাজ পড়ে সেমাই খেয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে গেলাম এক আত্মীয়ের বাড়িতে। পথে একটা সেনা ক্যাম্প পড়ে। সেখানে কয়েকজন মিলিটারি দেখে আমরা দুরুদুরু বুকে এগোতে লাগলাম। আমার মাথায় জিন্নাহ টুপি, গায়ে কালো পোশাক। সেই সময় রাজাকারদের ইউনিফর্ম ছিল কালো পোশাক। মায়ের নির্দেশে আমরাও বাইরে গেলে তাই কালো পোশাক পরে যেতাম। ঈদের দিন মিলিটারির ডাক পেয়ে ভড়কে যাই। কয়েক পা এগোতেই, এক সেনা হেসে বলল, ‘ঈদ মোবারক নেহি বোলগে?’
অনুলিখন: আহমেদ মুনির, চট্টগ্রাম