১৫ টাকা দিয়ে কেনা এক ভালোবাসা
ভালোবাসা গড়ে তোলা এবং বজায় রাখা নাকি ভীষণ ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। কারও কারও জীবনের অভিজ্ঞতা বোধ হয় তেমনটাই বলে। আজ এমন এক ভালোবাসার গল্প শোনাব, যা ‘কিনতে’ খরচ হয়েছিল মাত্র ১৫ টাকা আর ছোট্ট একটি বাক্য। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কোথায় হারিয়ে গেল সেই ভালোবাসা, তার উত্তর আজও অজানা। আজ ২৬ আগস্ট, আন্তর্জাতিক কুকুর দিবসে পড়ুন আমার বন্ধু ‘টুসু’র কথা।
দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটিয়ে আপনার হাতে যদি কেবল ১৫ টাকা থাকে, তা দিয়ে আপনি কী করবেন? কাউকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে দেবেন কি? প্যাকেটটা পেয়ে তিনি কি আনন্দিত হবেন? আদতে মাত্র ১৫ টাকায় আনন্দ ‘কেনা’ একটু মুশকিলই বটে। যাক সে কথা। আমি কীভাবে ১৫ টাকায় অপরিসীম আনন্দ আর অবাক ভালোবাসা ‘কিনেছিলাম’, সেই গল্প বলি।
পেশাগত প্রয়োজনে প্রায় রোজ সকালে সেখানে যেতাম আমি। দু-তিনটি কুকুর দেখতাম পথের ধারে। তাদের টুকটাক খাবার দিতাম। এমনই একসময়ে তার সঙ্গে দেখা। দেখে বোঝা যায়, সে–ও ক্ষুধার্ত। আমার কুকুরদের সঙ্গে সে–ও খেতে চায়। তার গায়ের রং সাদা। কিছু লালচে ছোপ আছে মাথায়, গায়ে। ওই জায়গার অন্য কুকুরগুলোর চেয়ে দেখতে আলাদা সে। সামান্য খাবার দিলাম তাকে। বুঝতে পারলাম, তাতে তার পেট ভরল না। বাকি খাবারটা অন্যদের দিতে যেতেই সে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। না না, আমার দিকে তেড়ে আসেনি।
যাদেরকে খাবার দিচ্ছিলাম, তাদের সঙ্গে মারামারি শুরু করল সে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি মারামারি থামাতে হাতের খাবারটাই ছুড়ে দিলাম ওদের দিকে। সাদা কুকুরটাকে বলছিলাম, ‘তুমি যদি এমন না করো, তাহলে তোমাকে ভালোবাসব।’ বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, মারামারি থামিয়ে মায়া মায়া চোখে আমার দিকে তাকাল সে।
পরে অবশ্য সত্যিই চেষ্টা করেছি তাকে ভালোবাসার পরশ দিতে। যেটুকু খাবার নিয়ে আসতাম বাসা থেকে, তাতে সব কুকুরের পেট ভরত না। দোকান থেকে বিস্কুট কিনে দিতাম। বলা যায়, ১৫ টাকা দামের ওই বিস্কুটের প্যাকেটগুলোর কারণেই আমি সেদিনের সেই ভালোবাসার ‘প্রতিশ্রুতি’ রাখতে পেরেছিলাম। সে–ও কিন্তু কথা রেখেছে। আমার ভালোবাসা পেয়ে ওই কুকুরদের আর মারেনি সে। আমাকে দেখলে কী যে খুশি হতো! একটা নামও দিয়েছিলাম ওর—টুসু।
পথের ওই জায়গাটা পেরিয়ে কাজের জায়গায় পৌঁছাতে হতো আমাকে সময়ের মধ্যে। ভবনটি পর্যন্ত আমার পিছু পিছু যেত ওখানকার কয়েকটি কুকুর। টুসুও থাকত তাদের মধ্যে। একবার দোতলায় উঠে গিয়েছিল আমার সঙ্গে। অনেকেই কুকুর দেখে ভয় পায়। যদিও এই ভয় অমূলক। তবুও চটজলদি নামিয়ে নিয়েছিলাম তাকে সেখান থেকে। তবে দারুণ বিস্মিত হয়েছিলাম তখন, যখন তাকে ফাঁকি দিতে পারব ভেবে লিফটে করে আটতলায় চলে যাওয়ার পরও সে নিচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে আমার কাছে চলে এল ঠিকঠাক!
ঘটনাটা বলি। টুসুকে ফাঁকি দিতে আমি লিফটে উঠে চলে গিয়েছিলাম কাজের জায়গায়। নয় তলার একটা ঘরে ঢুকেও গিয়েছিলাম। এসি চলছিল বলে দরজাটা টেনে দিয়েছিলাম। ১০ মিনিটও হয়নি, হঠাৎ দেখলাম, দরজাটা নিজে নিজে খুলে যাচ্ছে! মানে কারও মাথা বা হাত দেখা যাচ্ছে না দরজার ওপাশে। ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখি, টুসু এসে মাথা দিয়ে ঠেলে দরজা খুলে ফেলেছে। ওই ঘরের অন্যরা ভয় পাবেন বলে সেখান থেকেও দ্রুত ওকে নামিয়ে এনেছিলাম লিফটে করে। তবে প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিল টুসু। বুঝতে পারছিলাম, এভাবে নয়তলা সিঁড়ি ভেঙে আসাটা তার জন্য ছিল ভীষণ পরিশ্রমের ব্যাপার।
ভবনের নিচতলায় যে নিরাপত্তারক্ষী থাকেন, তিনি বোধ হয় একটু এদিক-ওদিক কোথাও ছিলেন। তিনি থাকলে টুসুকে ভবনের নিচ থেকেই তাড়িয়ে দিতেন। মজার ব্যাপার হলো, সে কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে ভবনের অন্য কোনো তলায় যায়নি। এমনকি নয়তলায় ওঠার পরও অন্য কোনো ঘরে ঢুকে পড়েনি। সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, আমি কোথায় আছি। আজও জানি না, সে তার কুকুরসত্তার তীক্ষ্ণ অনুভূতিশক্তিতে এমনটা করতে পেরেছিল, নাকি ভালোবাসার শক্তিতে! এমনটাও মনে পড়ে, একবার কাজ সেরে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসে উঠে পড়েছিলাম। বাসের দরজার কাছে এসে আমার ঘ্রাণ নিয়েছিল বেচারা টুসু!
আজ টুসু নেই আমার জীবনে। ওই জায়গায় আমি এখনো যাই মাঝেমধ্যে। তার দেখা পাই না। সম্ভবত তার বয়স হয়েছিল বেশ। এলাকার তরুণ কুকুরদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। মাঝে একবার শুনেছিলাম, পাশেই কোথাও থাকে সে। তবে আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আজও মনে পড়ে, আমার হাত থেকে কী ভীষণ সাবধানে খাবারটা মুখে নিত সে, যাতে ওর দাঁতে আমি আঘাত না পাই। তবে একটা ব্যাপার কী জানেন? কত জায়গায় কত কুকুরকেই তো এই বিস্কুট দিয়েছি, সবাই সব সময় সাবধানতার সঙ্গেই আমার হাত থেকে খাবার নিয়েছে। কিন্তু মনে হয়, টুসু আমার হাত থেকে বিস্কুট নিত সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার সঙ্গে।