বছরের পর বছর চলে গেছে, তবু পূজার সেই স্মৃতি ম্লান হয়নি
খুলনা আমার খুবই আপন শহর। খুলনায় কাটানো ছেলেবেলা, পূজার দিনগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে।
পঞ্চমীর রাত কেটে আসে ষষ্ঠীর সকাল। পূজার বাজার করতে করতে দিন চলে যায়। পূজার বাজার মানে সবার জন্য কিছু না কিছু কেনা। মনে হয় কালই পঞ্চমী ছিল, দেখতে দেখতে অষ্টমী চলে আসবে। অষ্টমীতেই মনে হয় আসল পূজা শুরু হয়। সকালে অঞ্জলি আর সন্ধ্যা থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখা। ধর্মসভা, কালীবাড়ি, কয়লাঘাট মন্দির, শ্মশান মন্দির, দোলখোলা শীতলাবাড়ি মন্দির তো যাবই, পূজা দেখতে মাঝেমধ্যে রূপসা নদীর ওপারেও যেতাম। রাতে আলোয় সেজে উঠত যেন পুরো শহর। ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে ভেসে আসত জনপ্রিয় গানগুলো—‘এবার পুজোয় চাই যে আমার বেনারসি শাড়ি।’
অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যেতাম বড় বাজারের সর্বজনীন কালীবাড়ি মণ্ডপে। উপোস রেখে অঞ্জলি দিতে হয়, তাই সকাল থেকে না খেয়ে থাকতাম। বাবা সকালে দোকানে যেতেন, পরে বাসায় এসে খবর দিতেন যে অঞ্জলি শুরু হয়েছে। সবাই সকাল থেকেই প্রস্তুত থাকতাম। একটু একটু ঠান্ডা পড়ত দেখে স্নান করতে একচোট মনোমালিন্যও হয়ে যেত মায়ের সঙ্গে। এই দিনগুলো ছাড়া একান্নবর্তী পরিবারের সবাই কখনো একসঙ্গে বের হওয়া হতো না। ওই দিন বাসার সবাই মা, বাবা, বড়মা, ঠাকুমা, ছোড়দা, বড়দা একসঙ্গে বের হতাম নতুন জামা-কাপড় পরে। অঞ্জলি দিতে গিয়ে আরেক মিলনমেলা, পরিচিত সবার সঙ্গে দেখা হতো। ঠাকুরমশাই ছোটবেলা থেকে আমাকে চিনত, একটু বেশি করে ফুল দিয়ে দিত হাতে। বলত ‘এবার সবাই হাতজোড় করে আমার সাথে সাথে বলুন...নমঃ মহিষগ্নি মহামায়ে চামুন্ডে মুন্ডমালিনি। আয়ুরারোগ্য বিজয়ং দেহি দেবী নমোহস্তুতে।’
আমরা বাকিরা পাঠশালার মতো তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র পড়ে প্রার্থনা করতাম। অনেক শব্দ বুঝতাম না, কিছু শব্দের মানে বুঝিয়ে দিত, কিন্তু আবহটা বুঝতাম, আনন্দের।
অষ্টমীর দিন রাতে নতুন কেনা সবচেয়ে ভালো জামা পরে ঘুরতে যেতাম। রাত আটটার দিকে বের হয়ে শহরের সব কয়টা পুজামণ্ডপে ঢুঁ দিয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে রাত একটাও বেজে যেত। রাতের খাবারটা সবাই মিলে বাইরেই খাওয়া হতো। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই এক দিন বাইরে খাওয়াও ছিল অনেক অপেক্ষার। এই দিন পায়ে ব্যথা-ট্যথা কিচ্ছু হতো না। দিব্যি টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম। নবমীতে সকালে হয়তো বান্ধবীদের সঙ্গে, রাতে আবার খুলনার বাইরে যাওয়া হতো ঠাকুর দেখতে।
এই পূজা পূজা...অষ্টমী, নবমী পার হতে হতেই মন খারাপ শুরু হতো। সকাল সকাল দর্পণ বিসর্জন দেখতে যেতাম। প্রতিমা বিসর্জনের আগে তিথি দেখে জলের ভেতর ছায়া দেখে দেবীকে বিদায় জানানো। তখন ঢাকের বাদ্যও আলাদা হয়ে যেত। কেমন একটা তালে যেন ঢাকিরা ঢাক বাজাতেন, ‘আসছে বছর আবার হবে’; তার মানে এবারের মতো মাকে বিদায়। ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে যাবে আবার কৈলাস।
সেই কবে খুলনা ছেড়ে ঢাকায় এসেছি। বছরের পর বছর চলে যায়, পূজার সেই স্মৃতি আর ম্লান হয় না।