রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় বাবাকে হারিয়ে নতুন করে পথচলা
দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে চিকিৎসক হয়েছেন আওলাদ হোসেন। অ্যাসিড-সন্ত্রাসে দুই চোখ হারিয়েও নতুন দিনের অপেক্ষায় আছেন মাসুদা আক্তার। দুর্ঘটনায় বাবাকে হারানো খাদিজা আক্তার এবার নার্সিং কলেজে ভর্তি হলেন। আরও অনেক লড়াকু মানুষের মতো এই তিনজন মানুষের এগিয়ে চলার পথে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাসে তাঁদের তিনজনের গল্প ছাপা হয়েছে শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে। এখানে পড়ুন খাদিজা আক্তার–এর জীবনের গল্প।
চাকরির কারণে আব্বু আর আম্মু তখন বরিশালে থাকেন; আর আমি নানাবাড়ি গোপালগঞ্জে থাকি। নানি আর খালার কাছেই আমি বড় হয়েছি। তাই ছোটবেলায় খালাকেই আম্মু মনে করতাম।
বরিশাল থেকে গোপালগঞ্জ খুব বেশি দূরের পথ না। প্রায়ই আমাকে দেখতে আসতেন আম্মু–আব্বু। তাঁরা এলে খুব মজা হতো। আম্মুর সঙ্গে লুডু, ক্যারম ও কানামাছি খেলতাম। এমনই একদিন আব্বু আমাকে একটি ভিডিও দেখিয়েছিলেন। সেটি সম্ভবত কোরীয় কোনো সিনেমার অংশ। ডাক্তাররা কীভাবে অপারেশন করেন, সেটিই ছিল বিষয়। ভিডিওটা দেখে ভয় পাওয়ার কথা; কিন্তু কেন যেন আমার খুব আগ্রহ বাড়ল। ডাক্তার হতে ইচ্ছা করল। পরে স্কুলে যাওয়া শুরু করলে আব্বু আমাকে অনুপ্রাণিত করলেন, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখান।
২০১২ সাল। আমার বয়স তখন সাড়ে সাত কি আট বছর। পরিবারের মধ্যে তখন মনোমালিন্য হলো। আব্বু-আম্মু বরিশাল ছেড়ে সাভারে চলে এলেন। আমাকেও একদিন নানাবাড়ি থেকে আনালেন। সাভারের স্কুলে ভর্তি করা হলো।
আমরা যে সাভারে এসে উঠেছি, এ কথা পরিবারের অন্যরা জানতেন না। আব্বু-আম্মু দুজনেই রানা প্লাজায় চাকরি নিলেন। তাঁরা কাজে যান, আমি বাসায় থাকি।
প্রতিদিনের মতো ওই বছরের ২৪ এপ্রিল দুজন কাজে গেলেন। সেদিনের ঘটনা আমার আবছা মনে আছে। একসময় প্রতিবেশী আন্টিদের মাধ্যমে জানতে পারি, রানা প্লাজা ধসে পড়েছে। আমি অত কিছু বুঝি না। তাঁদের সঙ্গে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ে যাই। দেখি, সারি সারি লাশ। আব্বু-আম্মু কোথায় আমি জানি না।
আমার কাছে কেউ একজন পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর চাইলে নানুর নম্বর বলি। নানুর মোবাইল নম্বর আমার মুখস্থ ছিল। তিনি ফোন করে সাভারের দুর্ঘটনার কথা জানান।
নানাবাড়ি ও দাদাবাড়ি থেকে লোকজন চলে আসেন। ৭২ ঘণ্টা পর আম্মুকে খুঁজে পাওয়া যায় হাসপাতালে। আম্মু তখন অসুস্থ। যতটা না আহত হয়েছেন, তারচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন মানসিকভাবে। আর আব্বু? আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে যখন হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলেন, তখন বুঝতে পারি, আব্বু আর নেই। আর কখনো ফিরবেন না।
গ্রামের বাড়িতে আব্বুকে দাফন করা হলো। শুরু হয় মায়ের কষ্টের জীবন। তিনি ছোট একটি কাজ জোগাড় করলেন। বেতন আট হাজার টাকা। এ দিয়ে তো দুজনের সংসার চলে না। আমার পড়াশোনার খরচও আছে। রানা প্লাজা ধসের পর বিভিন্ন সহায়তা পাওয়া গেল। তাতেই পড়াশোনা চলতে থাকল।
২০১৯ সালে সব সহায়তা বন্ধ হয়ে গেল। অকূলপাথারে পড়লাম আমি আর আম্মু। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বিজ্ঞান বিভাগে বেশ কয়েকটা প্রাইভেট পড়তে হয়। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। কীভাবে চলবে আমার পড়াশোনা?
এক আন্টির মাধ্যমে প্রথম আলো ট্রাস্টের কথা জানতে পারি। মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলে বৃত্তির জন্য আবেদন করি। যাচাই–বাছাইয়ের পর বৃত্তিটি পেয়েও যাই। আমার পড়াশোনা সহজ করে দেয় মাসিক এই সহায়তা।
২০২১ সালে এসএসসি পাস করি, আর ২০২৩ সালে এইচএসসি। এইচএসসি পরীক্ষার সময় আমার ডেঙ্গু হয়েছিল। স্বাস্থ্যের সঙ্গে ফলাফলেও তার প্রভাব পড়েছিল। আমি জিপিএ–৪ পাই। ফলের আগেই মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। রেজাল্ট প্রকাশের পর ভেঙে পড়ি। এই রেজাল্টে ভর্তি হতে পারব না। ছোটবেলার স্বপ্নটা ভেস্তে যায়।
আম্মু তখন আমাকে সাহস দেন। চিকিৎসক না হলে নার্স হবে, নার্সিং পেশাও সম্মানের, এর মাধ্যমেও মানুষকে সহায়তা করা যায়। আসলে আব্বু মারা যাওয়ার পর আম্মুই আমার বাবা, আম্মুই আমার মা। আম্মু চাইতেন, আমি যেন আব্বুর শূন্যতা বুঝতে না পারি। তাই যা চেয়েছি, সেটিই দিয়েছেন।
এরপর নার্সিংয়ে ভর্তির জন্য পড়াশোনা করলাম। পরীক্ষা দিয়ে সিআরপি (পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র) নার্সিং কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলাম। কয়েক মাস ক্লাস করছি। এখন আমার স্বপ্ন নার্সিং কলেজে শিক্ষক হয়ে ক্যারিয়ার গড়া। আশা করি, সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়া পর্যন্ত প্রথম আলো ট্রাস্ট আমার সঙ্গেই থাকবে। মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের বৃত্তিটি ছাড়া যে এতটুকুও আসা হতো না।
অনুলিখন: সজীব মিয়া