ডুবুরি আলমের ভিডিও দেখেন লাখ লাখ মানুষ, পেয়েছেন সিলভার বাটন

ডুবে যাওয়া বাল্কহেড, লাইটার জাহাজ তোলাই আলম মিয়ার কাজ। উদ্ধার অভিযানের সেসব ভিডিও তাঁর ‘আলম ডুবুরি’ চ্যানেলে দেখা হয়েছে লাখ লাখ বার। কিশোরগঞ্জের এই তরুণের কাছে তাঁর ডুবুরি হয়ে ওঠার গল্প শুনলেন সজীব মিয়াতাফসিলুল আজিজ

প্লাস্টিকের ড্রাম ব্যবহার করে ডুবে যাওয়া নৌযান তুলে আনেন আলম ডুবুরিছবি: সংগৃহীত

আলম মিয়ার ডুবুরি হয়ে ওঠার পেছনে মন খারাপ করা একটা ঘটনা আছে। এক যুগ আগের সেই ঘটনাটা বলতে গেলে এখনো শোকে কাতর হয়ে ওঠেন এই তরুণ।

আলমদের বাড়ির পাশেই ঘোড়াউত্রা নদী। এই নদীতেই সাঁতার কাটতে নেমেছিল আলমের এক চাচাতো ভাই। ১১ বছরের শিশুটা আর পাড়ে উঠতে পারেনি। নদীতে ডুবে যায়। ঘণ্টা দুয়েক চেষ্টা করেও কেউ তাকে খুঁজে পায় না। ভরদুপুরে মাছ ধরে বাড়ি ফেরার পর ঘটনাটা জানতে পারেন আলম। এসে দেখেন বাড়িতে মাতম চলছে, নদীর পাড়ে মানুষের ভিড়। ছোট ভাইয়ের দুরন্ত চেহারা ভেসে ওঠে আলমের মনে। ছুটে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন। ডুবে ডুবে খুঁজতে শুরু করেন। একসময় পেয়েও যান। কিন্তু ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছে ভাইয়ের দেহ।

আলমের কেবলই মনে হতে থাকে, এলাকায় ভালো একজন ডুবুরি থাকলে শিশুটা বেঁচেও যেতে পারত। বসে বসে এরপর প্রায়ই ভাবেন, ভালো ডুবুরি হলে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন তিনি।

কিন্তু ডুবুরি হওয়া তো সহজ কাজ নয়।

আরও পড়ুন
আলম মিয়ার ডুবুরি হয়ে ওঠার পেছনে আছে মন খারাপ করা একটা ঘটনা
ছবি: প্রথম আলো

আলম যেভাবে ডুবুরি

আলমদের গ্রামের নাম ছাতিরচর। কিশোরগঞ্জের নিকলীর এই গ্রামের কাছেই চুনাপাথরবোঝাই একটা বাল্কহেড ডুবে যায়। জলযানটি উদ্ধার করতে আসে ঢাকার একটা ডুবুরি দল। দলের নেতা মোহাম্মদ আবদুল, সবাই ডাকে ‘আবদুল ওস্তাদ’। এক যুগ আগের ঘটনাটা আলমের মনে ভেসে ওঠে ছবির মতো, ‘তহন আমি মাছ ধরি। দুপ্রের (দুপুরের) পর আমার কোনো কাম থাকে না। নৌকা নিয়া গিয়া বসে বসে বলগেট (বাল্কহেড) তুলা দেহি।’

কখনো উদ্ধারকারী নৌযানের কাছে নিজের নৌকা নিয়ে বসে থাকেন আলম। কখনো উঠে যান উদ্ধারকারী নৌকায়। ডুবুরিদের আগবাড়িয়ে এটা-সেটা এগিয়ে দেন। একদিন তো অক্সিজেন মাস্কটাই পরে ফেললেন। আর সেটা দেখেই তেতে গেলেন আবদুল ওস্তাদ। অনুমতি ছাড়া জিনিসপত্রে হাত দেওয়াটা তাঁর অপছন্দ। আলম অবশ্য ওস্তাদের রাগে মন খারাপ করেন না। পরদিন আবার যান। এভাবে ১৫ দিন কেটে যায়। একদিন আবদুল নিজেই ডেকে কাজ দেন, আর আলমও খুব আগ্রহ নিয়ে কাজটা করেন। সুযোগ পেয়ে ডুবুরি হওয়ার ইচ্ছার কথাটাও ওস্তাদকে বলেন। আলম বলেন, ‘পর দিনোই ওস্তাদ আমার মুখে মাস্ক লাগায়া দেন।’

ডুবে যাওয়া বাল্কহেড থেকে আগে চুনাপাথর তোলা হচ্ছিল। আলমও অন্যদের মতো ডুবে ডুবে চুনাপাথর তুলে আনতেন। দেখা যেত অন্য ডুবুরিদের চেয়ে আলম দ্রুত কাজ করতেন। তাঁর কাজ দেখে আবদুল ওস্তাদ খুব খুশি হন। মাস খানেক পর উদ্ধারকাজ শেষ হলে আলমকে প্রস্তাব দেন তাঁর দলের সঙ্গে যুক্ত হতে।

এরপর মাঝেমধ্যেই ওস্তাদের ডাক পেতে থাকেন আলম।

আরও পড়ুন
দলের সদস্যদের সঙ্গে আলম
ছবি: প্রথম আলো

বাজিতপুর সালভেজ

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওস্তাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন আলম। তিনিই একদিন ব্যবসার অংশী হওয়ার প্রস্তাব দেন। আলম বলেন, ‘ওস্তাদের বয়স হয়ে গেছিল। আমারে পছন্দ করত বইলাই হে আমারে শেয়ার লইতে কইছিল। কিন্তু আমি টাকা পামু কই।’

উদ্ধারকারী সরঞ্জামের বাজারমূল্য ছিল ১৭ লাখ টাকা। তিন ভাগের এক ভাগ আলমকে দিতে হতো। আলম এক লাখ টাকায় অংশী হতে চাইলে তাতেই রাজি হয়ে যান ওস্তাদ। বাকি টাকা শোধ করেন তিন বছর কাজ করে। মোহাম্মদ আবদুল আর এখন নেই। বিপ্লব চৌধুরী ও আলমের নেতৃত্বে চলে ‘বাজিতপুর সালভেজ’। তবে ‘আলম ডুবুরি’ নামেই প্রতিষ্ঠানটি বেশি পরিচিত। তাঁদের দলের সদস্য এখন ১৩।

উদ্ধারকাজের জন্য তাঁদের আছে একটি স্টিলের নৌকা, দুটি অক্সিজেন কম্প্রেসর, দুটি ড্রেজার মেশিন, ২৫০ ফুট লতা পাইপ। লাইন, অক্সিজেন মাস্ক, প্লাস্টিকের ৭০০ ড্রাম আর শীতকালে পানিতে নামার জন্য বিশেষ পোশাক রয়েছে। আলম বলেন, উদ্ধারকাজের জন্য এগুলো পর্যাপ্ত নয়। আরও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও পোশাক দরকার। কিন্তু অর্থাভাবে জোগাড় করতে পারছেন না।

আরও পড়ুন
ইউটিউব থেকে সিলভার প্লে বাটন পেয়েছেন আলম
ছবি: সংগৃহীত

আলম যেভাবে ইউটিউবার

অনেক সময় নৌযানডুবির খবর শুনে উদ্ধারকাজের প্রস্তাব পাঠান আলম। মালিকেরা তখন দক্ষতার প্রমাণ চান। কিন্তু তাৎক্ষণিক কিছু দেখাতে পারেন না। কাজ হাতছাড়া হয়ে যায়। আলম বলেন, ‘আমি ছোডোখাডো মানুষ। ডুবুরি হইলে হইতে হয় তাগড়া। তাই কাজ করতে পারমু না বইলা মালিকেরা কাজ দিত না। আমি যে অনেক কাজ করছি, সেই কাজের প্রমাণ দেখাইতে ফারতাম না।’

সমস্যার সমাধান দিলেন তাঁরই দলের এক ছোট ভাই। সে-ই একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে দিল। এর পর থেকে উদ্ধারকাজে গেলেই ভিডিও করে ‘আলম ডুবুরি’ চ্যানেলে আপলোড দিতেন।

অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়ে যান ‘আলম ডুবুরি’। ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর চালু করা চ্যানেলটিতে এখন ৩ লাখ ৭৮ হাজার সাবস্ক্রাইবার (১৪ জুলাই পর্যন্ত)। চ্যানেলের লাইটার জাহাজ উদ্ধারের ভিডিওটি সর্বোচ্চ প্রায় ২৩ লাখবার দেখা হয়েছে। আলম বলেন, ‘আমার তো একবিন্দু পড়ালেখা নাই। আমি এসব কিছুই বুঝি না। আমার সাথের ছেলেটা এই সব করত।’

এখন কাজের প্রস্তাব দেওয়ার সময় প্রমাণ হিসেবে ইউটিউব লিংক পাঠিয়ে দেন। ভিডিও দেখে অনেকে কাজও দেন। এক লাখ সাবস্ক্রাইবার হওয়ার পর ইউটিউব থেকে সিলভার প্লেবাটন পেয়েছেন আলম ডুবুরি। চ্যানেলটি থেকে প্রথম আয় হয় ৪০ হাজার টাকা। এরপর প্রতি মাসেই ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পাচ্ছিলেন। তবে ইউটিউবের নীতিমালা জটিলতায় কয়েক মাস থেকে মনিটাইজেশন বন্ধ আছে।

ইউটিউবার হিসেবে এলাকায় তারকাখ্যাতিও জুটেছে। আলম ডুবুরি বলেন, ‘একবার কামরাঙ্গীরচর গেছি। যাইয়া দেখি চা-স্টলের লোকজন আমার ভিডিও দেখতাছে। সেদিন আমার খুব আনন্দ হইছিল।’

যেভাবে তোলা হয় ডুবে যাওয়া যান

উদ্ধারকাজে একসময় বড় নৌযান নিয়ে যেতে হতো। লোহার শিকল দিয়ে টেনে তুলতে হতো ডুবে যাওয়া বাল্কহেড, লঞ্চ, লাইটার। এখন নতুন কৌশলে প্লাস্টিকের ড্রাম ব্যবহার করে কাজ করেন আলম ডুবুরি। দাবি করলেন, উদ্ধার পদ্ধতিটি তিনি নিজে নিজেই আয়ত্ত করেছেন।

এই পদ্ধতিতে শুরুতে ডুবন্ত নৌযানটি খালি করা হয়। এরপর পানিভর্তি প্লাস্টিকের ড্রাম নৌযানের ভেতরে ঢোকানো হয়। এরপর কম্প্রেসরের সাহায্যে ড্রামে হাওয়া দেওয়া হয়। পানি বের হয়ে হাওয়ায় পূর্ণ হয়ে যায় ড্রাম। সব ড্রাম হাওয়ায় ভরে উঠলে ডুবন্ত নৌযানটাও ভেসে ওঠে। নৌযানের আকার অনুযায়ী ২০০ থেকে ৫০০ ড্রামেরও প্রয়োজন হয়। এই পদ্ধতিতে অনেক বড় বড় নৌযান তুলেছে আলম ডুবুরির দল।

কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। একবার বঙ্গবন্ধু সেতুর ৮ নম্বর পিলারের কাছে একটি বালুবাহী বাল্কহেড ডুবে গিয়েছিল। যমুনা নদীতে তখন তীব্র স্রোত। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো ডুবুরি দলকে রাজি করতে পারেনি মালিকপক্ষ। সেই কাজটিই নেন আলম ডুবুরি। কাজ করতে করতে একদিন ইঞ্জিন রুমে গিয়ে দেখেন গলিত মৃতদেহ। ভয়ে আলমের দমবন্ধ হওয়ার জোগাড়। পরে জানতে পারেন এটি চালকের মৃতদেহ, তথ্যটি তাঁদের কাছে গোপন করেছিল মালিকপক্ষ। মন খারাপ হলেও মৃত ব্যক্তির স্বজনদের কথা ভেবে কাজটি করে দেন আলম।

আরেকবার চট্টগ্রামে একটা জাহাজ উদ্ধার করতে গিয়ে বুঝলেন বড় ভুল করে ফেলেছেন। নদী ও হাওরাঞ্চলে কাজ করে তাঁরা অভ্যস্ত। এসব এলাকার জলদুনিয়া তাঁদের মুখস্থ। কিন্তু চট্টগ্রামে যে নদীতে কাজটি করতে গেছেন, সেখানে জোয়ার-ভাটার খেলা চলে। ১ মাসের লক্ষ্য নিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন করতে তাঁদের লেগেছিল প্রায় ৭ মাস। বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন আলম। ১২ বছরে এমন অনেক ঘটনারই সাক্ষী আলম ডুবুরি।

তবু এই রোমাঞ্চকর পেশাতেই খুঁজে পান আনন্দ।