নতুন বইয়ে বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যাগুলো নিয়ে কতটা আলোচনা আছে

কেস ১: ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে দীপা। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়মিতই সে স্কুলে আসত। বরাবরই সে বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো করত। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই দেখা গেল প্রতি মাসেই একটি নির্দিষ্ট সময়ে কয়েক দিন সে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। এ সময় সে বাড়িতে থাকে। এ কারণে শ্রেণির কাজে অংশ নিতে পারে না। এতে তার পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয়। একদিকে পড়াশোনার ক্ষতি, অন্যদিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। কী করবে ভেবে পায় না। সারাক্ষণই মনমরা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে সে লজ্জাবোধ করে। নানা ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তার মনে ভর করে। বিদ্যালয়ে সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী এমনকি মায়ের সঙ্গেও তেমন কথা বলে না। একা থাকতে চায়, সবার সামনে আসতে চায় না। সাময়িক পরীক্ষায় এ বছর সে আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। সে সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকে।

কেস ২: রানা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সে নিয়মিত স্কুলে যায়। তার প্রতিবেশী, পরিবারের সবার কাছেই সে স্নেহের পাত্র। কিন্তু কিছুদিন থেকে সে কারও সঙ্গে খেলাধুলা করে না। স্কুলেও নিয়মিত যায় না। মাঝেমধ্যে অস্থির হয়ে ওঠে। তার এ অস্থিরতার কারণ কাউকে সে খুলে বলতে পারে না। তার মা খেয়াল করলেন, তার ঘরে
কাউকে সে আসতে দেয় না। নিজের কাপড়চোপড়ও কাউকে ধরতে দেয় না। হঠাৎ করেই রেগে যায়। কিছু বলতে গেলে সে কখনো সংকোচ বা লজ্জাবোধ করে। এমন পরিস্থিতিতে তার আশপাশে যারা থাকত, তারাও ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। তার নিজের এমন অবস্থা নিয়ে সে নিজেই শঙ্কিত।

কেস দুটি এ বছরের ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ের একটি অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে। কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন বোঝাতে গিয়ে এসব উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। শুধু উদাহরণ দিয়েই থেমে যায়নি; বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পরিবর্তনের বিষয়ে যেসব প্রশ্ন জাগে, সেসব সমাধানেরও পথ দেখানো হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি এই বইয়ে বিশদভাবে কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির নতুন বইয়েও স্থান পেয়েছে এসব বিষয়।

চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। আগামী বছর চালু হবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালুর মধ্য দিয়ে পুরোপুরিভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথাগত পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এই শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে নানা বাস্তব ঘটনায় শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পরিবর্তনের যাত্রা

এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, কৈশোর জীবনের বিষয়গুলো আগে বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক বইয়ে স্থান পেলেও এবার বিশদভাবে স্থান পেয়েছে। কারণ, ভালো থাকার জন্য এগুলো জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইয়েও গুরুত্ব অনুসারে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে ৪১ থেকে ৫৫ পৃষ্ঠাজুড়ে স্থান পেয়েছে কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তনের বিষয়টি। জীবনের এই স্বাভাবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই প্রত্যেক মানুষকে যেতে হয়। ‘আমার কৈশোরের যত্ন’ নামের অধ্যায়কে ‘পরিবর্তনের যাত্রা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই যাত্রায় শারীরিক ও মানসিক যেসব পরিবর্তন হয়, সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের শেখানোর চেষ্টা হয়েছে। প্রথমে দুটি কমিকস দিয়ে বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের যেসব পরিবর্তন হয়, সেটা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে কমিকস দুটি নিয়ে শিক্ষক ও সহপাঠীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হবে। এ ছাড়া বইয়ের মধ্যেই নির্দিষ্ট জায়গায় বয়ঃসন্ধিকাল–সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। যার উত্তর শিক্ষার্থীরা লিখবে। যেমন একটি প্রশ্ন হলো ‘আমার শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করছি।’ এ রকম করে ধীরে ধীরে প্রশ্নগুলোর সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

রোগ নয়, স্বাভাবিক প্রক্রিয়া

‘আমার কৈশোরের যত্ন’ অধ্যায়ের একাংশে বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে প্রচলিত যেসব ভুল আছে, সেগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি সঠিক তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন মেয়েদের মাসিক সম্পর্কে কয়েকটি ভুল ধারণা হলো: এটা একধরনের রোগ, এ সময়ে কোনো কাজ বা খেলাধুলা করা যাবে না, গোসল করা যাবে না, বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না, এ সময়ে টক, ঝাল, মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া যাবে না। ভুলগুলোর বিপরীতে সঠিক তথ্যগুলো হলো: এটা শারীরবৃত্তীয় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, স্বাভাবিক কাজকর্ম ও খেলাধুলা করাতে কোনো সমস্যা নেই, নিয়মিত গোসল করতে হবে, বাড়ির বাইরে যেতে কোনো অসুবিধা নেই, নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

বীর্যপাত নিয়েও কিছু ভুল ধারণার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ভুল ধারণাগুলো হলো: বীর্যপাত একটি রোগ, যারা কুরুচিকর চিন্তা করে, তাদেরই বীর্যপাত হয়, এটি শারীরিক দুর্বলতার কারণ। অথচ সঠিক তথ্য হলো: এটি শারীরবৃত্তীয় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, বয়ঃসন্ধিকালে সব কিশোরেরই এটি হয়, শারীরিক দুর্বলতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

এ অধ্যায়ে শরীরের পাশাপাশি মনের যত্নে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কেও বলা হয়েছে।

কৈশোরের আনন্দযাত্রা

সপ্তম শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়েও কৈশোরকালের নানা বিষয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ‘কৈশোরের আনন্দযাত্রা’ নামের এ অধ্যায়ে ৫০ থেকে ৬৮ পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীরা যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, সেগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি সমাধানের পথ দেখানো হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করতে সাধারণ হয়রানি ও নিপীড়নের ধরনগুলোও তুলে ধরা হয়। যেমন যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন বোঝাতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, অশোভন কথা, অঙ্গভঙ্গি, ইঙ্গিত বা উত্ত্যক্ত করা, কুরুচিপূর্ণ আচরণ, নোংরা কুরুচিপূর্ণ ছবি দেখানো, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা বিদ্রূপ করা, ভয় দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক করতে বাধ্য করা এবং এর ছবি বা ভিডিও তৈরি ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। এসব নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করার কিছু সাধারণ কৌশলও তুলে ধরা হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি করা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বই দুটির অন্যতম রচয়িতা ও সম্পাদক এনসিটিবির শিক্ষাক্রম–বিশেষজ্ঞ রুমী জেসমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভালো থাকার জন্য ছেলে–মেয়েদের জন্য কী কী দরকার, সেসব বিষয় মাথা রেখে এসব বই প্রণয়ন করা হয়েছে। যেখানে কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তনের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। শরীরের সঙ্গে মনও ভালো থাকা দরকার। সেসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে এ বইয়ে।