রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কি পরিবর্তন আসছে
সড়কটির নাম কেন ‘প্যারিস রোড’?
প্রশ্নটা হয়তো ঘুরেফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সব শিক্ষার্থীর মাথায়ই এসেছে। কেউ বলে, দুই পাশে সার বেঁধে দাঁড়ানো গগন শিরীষগাছগুলো প্যারিস থেকে আনা হয়েছিল বলে এই নাম। রাস্তাটা দেখতে ফ্রান্সের প্যারিসের বুলেভার্ডের মতো, এমন যুক্তিও কেউ কেউ দেন। তবে সঠিক উত্তর কারও জানা নেই।
উত্তর জানা থাক বা না থাক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই জানেন, কাজলা গেট থেকে শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হল পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রাস্তার একটা আলাদা মায়া আছে। শীত, বর্ষা কিংবা গ্রীষ্ম, প্রতি ঋতুতেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দেয় প্যারিস রোড। বন্ধুত্ব, প্রেম থেকে শুরু করে আন্দোলন—এখানে এসে মেশে সব।
প্যারিস রোডে হাঁটতে হাঁটতেই শিক্ষার্থীদের একটি দলের সঙ্গে কথা হলো। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিকিরণ চাকমা বলছিলেন, ‘বিকেলে একবার হলেও এই রাস্তায় আমরা হাঁটি। আমরা যারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি, তাদের কাছে এই রোড কখনো পুরোনো হয় না। দিনের বেলা হাঁটলে এক রকম অনুভূতি, রাতের বেলায় আরেক।’
বিকিরণের সঙ্গে যোগ করলেন সহপাঠী মিঠু নন্দী, ‘ক্যাম্পাসে এসেছি প্রায় তিন বছর। চট্টগ্রাম থেকে এত দূরে পড়তে আসাটা আমার জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে নিজের বিভাগ তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়কেই মনে হয় নিজের ঘরবাড়ি। যখন দেখি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমার ক্যাম্পাস ভালো করছে, ভালো লাগাটা তখন আরও বেড়ে যায়।’
প্যারিস রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছালাম জোহা চত্বরে। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। তাঁর সমাধি প্রাঙ্গণই বর্তমানে জোহা চত্বর। এখান থেকেই পুরো ক্যাম্পাসের সাজানো-গোছানো একটা রূপ চোখে পড়ে। বোঝা যায়, অবকাঠামোগুলো গড়া হয়েছে বেশ পরিকল্পনামাফিক।
মহাপরিকল্পনায় অবকাঠামো ও একাডেমিক উন্নয়ন
‘মতিহারের সবুজ চত্বর’ নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আলাদা একটা পরিচিতি আছে। নানা প্রজাতির গাছপালার কারণে ক্যাম্পাস যেমন সব সময়ই সবুজ, তেমনি প্রাণবন্ত আর গোছানো। একাডেমিক ভবন, ছেলে ও মেয়েদের আবাসিক হল, শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার, প্রশাসনিক ভবন, স্টেডিয়াম—সবকিছুই গড়ে উঠেছে নির্দিষ্ট জায়গায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নে শৃঙ্খলা আনতে নেওয়া হয়েছে ৫০ বছরের (২০২০-২০৭০) মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান)। ক্যাম্পাসের প্রায় ৭৫০ একরকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৌশলগত ও স্থানিক পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে একাডেমিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, গ্রন্থাগার আধুনিকীকরণ, আবাসিক ব্যবস্থার উন্নয়ন। এই পরিকল্পনার অধীন চলছে দুটি আবাসিক হল ও একটি একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ। সেই সঙ্গে একাডেমিক খাতেও বড় পরিবর্তন আনতে পাস হয়েছে একাডেমিক মহাপরিকল্পনা।
গবেষণায় যা কিছু অর্জন
১৯৫৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকেই দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক এ এইচ এম খুরশীদ আলম যেমন ২০১০ সাল থেকে একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে তুঁতের ক্যানসার প্রতিরোধী ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন। এই গবেষণায় তিনি পেয়েছেন, ক্যানসার ছাড়াও হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগপ্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করতে পারে তুঁত।
প্রায় ১৭০ বছর পর আবার বাংলাদেশে বোনা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনজুর হোসেন। অন্যদিকে দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে কাজ করছেন ফিশারিজ বিভাগের একদল গবেষক। প্রায় আটটি দেশি প্রজাতির মাছ হাওরে মজুত করতে সক্ষম হয়েছে অধ্যাপক ইয়ামিন হোসেনের নেতৃত্বে গবেষণা করা একটি দল। এ ছাড়া ইলিশ ধরার সময় পুনর্বিন্যাস, সামুদ্রিক মাছ ও মাছের খাদ্য ও বাসস্থানের নিয়ে নানামুখী গবেষণা করছেন তাঁরা।
সাপের বিষ নিয়ে দেশের একমাত্র ও প্রথম তথ্যভান্ডারটি (ডেটাবেজ) তৈরি করেছেন জেনেটিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবু রেজা। এ তথ্যভান্ডারের নাম স্নেকবিডি ডটকম। কালনাগিনী, গোখরো, শঙ্খিনী, ধামান, পাথরসহ প্রায় ৮৯টি সাপের বিষের বিস্তারিত তথ্য আছে এই ভান্ডারে। পাট ছাড়াই বিকল্প উপায়ে সোনালি আঁশ পাওয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উন্নত জাতের কলা উদ্ভাবন করেছেন প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।
আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে নজর
প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের সংখ্যার দিক থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে তৃতীয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণা হলেও সেগুলোর সঠিক উপস্থাপন ও তথ্য প্রদানে গাফিলতিসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা পাচ্ছিল না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এই ব্যাপারে সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে প্রথমবারের মতো টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা পেয়েছে রাবি। সর্বশেষ প্রকাশিত র্যাঙ্কিংয়ে ১ হাজার ১ থেকে ১ হাজার ২০০-র মধ্যে অবস্থান করছে তারা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিংয়েও এশিয়ার মধ্যে রাবির অবস্থান ৪৫১ থেকে ৫০০-র মধ্যে। এ ছাড়া ওয়েবমেট্রিকস র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রাবির অবস্থান দ্বিতীয় ও বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১ হাজার ১৯২তম।
গতি ফিরছে সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে
ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ও সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে গতিশীলতা থাকলেও পরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সাংস্কৃতিক ও সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমেও ফিরেছে গতিশীলতা। ক্যাম্পাসে বর্তমানে প্রায় ৪০টি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম চলছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আল-আমিন ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুধু দিবসকেন্দ্রিক আয়োজন না রেখে সারা বছরই সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রেখেছি। ফলে নতুন অনেক সংস্কৃতিকর্মী বের হচ্ছে, যারা ক্যাম্পাসের বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে দিচ্ছে। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্র হলে এই গতি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
খেলাধুলায়ও সাম্প্রতিক সময়ে সাফল্য পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট ও বাস্কেটবলের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন রাবি। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায়ও। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় ছাত্রীদের খেলায় রানার্সআপ হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রী হ্যান্ডবল দল।
উপাচার্য যা বললেন
গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় মানে আদান-প্রদান হবে—আমাদের শিক্ষার্থীরা অন্য দেশে যাবে, অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা আমাদের এখানে আসবে। তাই স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম নিয়ে এখন চিন্তাভাবনা করছি। সেই লক্ষ্যে আমাদের দুটি সেল কাজ করছে। আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করছি। চেষ্টা করছি বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ক্রেডিট ট্রান্সফার করার। তাহলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাইরের ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে।
আমরা আমাদের পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী করে তুলতেও কাজ করছি। ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের (আইকিউএসি) সহযোগিতায় এই কাজ চলছে। শিক্ষার্থীদের চাকরি পেতে যেন সুবিধা হয়, সেদিকেও মনোযোগ দিচ্ছি। এই লক্ষ্যে আগামী বছরের শুরুতে একাডেমি আর ইন্ডাস্ট্রি মিলে একটা আয়োজন করব। আমরা যেন বুঝতে পারি আমাদের ঘাটতি কোথায়, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং নিয়েও কিছু পরিকল্পনা আছে। গত বছর সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। তখন টাইমস হায়ার এডুকেশনের প্রতিনিধির সঙ্গে আমার কথা হয়। সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর থেকে তথ্য-উপাত্ত পাঠাতে শুরু করি। তবে বেশ কিছু সমস্যা আছে। যেমন বিদেশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, টিচার এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম—এসব আমাদের দেশের বাস্তবতায় কঠিন। আমরা চাইলেই বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে পারি না। কারণ, বিদেশি শিক্ষক আনলে তাঁদের মোটা অঙ্কের বেতন দিতে হবে। এগুলো আমরা সরকারকে জানিয়েছি। শুধু সরকার নয়, এ ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য সবার সম্মিলিত চেষ্টার প্রয়োজন।