আঁকতে যাই পাখি, হয়ে যায় মাছ
কাল পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। বর্ষবরণকে সামনে রেখে ‘স্বপ্ন নিয়ে’র পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই এমন এক শিল্পীর কথা, যাঁর তুলির টানে টানে ফুটে উঠত বাংলার নকশা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য। তিনি পটুয়া কামরুল হাসান (২ ডিসেম্বর ১৯২১-২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮)। কীভাবে তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল শিল্পসত্ত্বা? ‘আপন কথা’ নিবন্ধে সে কথা নিজেই লিখে গেছেন তিনি। ১৯৮৬ সালে লেখাটি ছাপা হয়েছিল মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত সুন্দরম পত্রিকায় (সংখ্যা ভাদ্র-কার্তিক ১৩৯৩)। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।
আব্বা, মা, এবং আমরা দুটি ভাই—এই নিয়ে আমাদের সংসার। এক ছুটির দিন, সকলেই বাড়িতে, আমি বোধ হয় একটু দুষ্টমি করছিলাম। তাই আমাকে শান্ত করবার জন্যে আব্বা আমাকে আদর করে কাছে ডেকে পাশে বসিয়ে বড় ভাইয়ের স্লেট পেনসিল সামনে ধরে বললেন, ‘আয় তোকে একটা মজার খেলা শেখাই।’ বড় ভাইয়ের স্লেটের ওপর আমার ছোট্ট ডান হাতের পাতা উপুড় করে বসিয়ে পাঁচ আঙুলের চারপাশে পেনসিলের দাগ বসিয়ে হাতের পাতাটি স্লেট থেকে ওপরে তুলে ধরতেই চোখে পড়ল স্লেটের ওপরে আমার ছোট হাতের পাঁচটি আঙুলের সুন্দর একখানি ছবি। নিজেই আমার হাতটা পেতে দিয়ে শিশু ভাষায় জানালাম আবার আমার হাত এঁকে দিতে। আগের ছবিটি মুছে দিয়ে আব্বা আমার হাত আবার আঁকলেন—এইভাবে বারবার আঁকা চলতে থাকল। অবসর এবং ভাইয়ার স্লেট পেনসিল হাতের নাগালে পেলেই আব্বার কাছে নিয়ে উপস্থিত হতাম। তিনিও বুঝতেন এবং স্লেটের পিঠে আমার হাতের ছবি ভেসে উঠতে থাকত বারংবার। এটা আমার নিত্যদিনের খেলা হয়ে দাঁড়াল। শেষে একদিন দেখা গেল আমি নিজেই নিজের হাত বসিয়ে আঁকছি স্লেটের ওপরে। এইভাবে খেলা করতে করতে বয়স কিছুটা বেড়ে গেল। তখন কথাও বলতে পারি। এদিকে ভাইয়ার স্লেটে নিজেই নিজের হাত আঁকা আমার নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু আঁকাতেই শেষ নয়, তা নিয়ে আব্বাকে দেখাই, অন্য সব আত্মীয়স্বজন—মামা-চাচাদেরও দেখাই। বাহবা নিই।
এভাবেই খেলার ছলে কখন আমার মনের কোণে ছবি আঁকার একটি লতাগুল্ম অঙ্কুরিত হয়েছিল, বলতে পারি না। তারপর বয়স একটু বাড়তেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় এসে গেল। আব্বা বড় ভাইকে যে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, সেই মডেল এম-ই স্কুলে আমাকেও ভর্তি করিয়ে দিলেন। ইনফ্যান্ট টু-তে। কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কুল। সাধারণ পড়াশোনার সঙ্গে ড্রইং আর মডেলিং ক্লাসের চমৎকার আয়োজন ছিল। আমি যেন এক নতুন আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগলাম মনের আনন্দে। ছবি আর ছবি। আজ দেখতে পাচ্ছি আমার সেই শিশুকালটাকে। নতুন দৃষ্টি মেলে। মাত্র ডিম ফেটে বের হয়েছি, চোখ ফুটেছে কিন্তু ডানা ভালো করে মেলতে পারি না, তাই উড়তে গিয়ে বারবার পড়ে যাই। হ্যাঁ, ছবি আঁকতে যাই পাখির, হয়ে যায় মাছ। এমনিভাবে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ছবির আকাশে সেই যে উড়তে আরম্ভ করেছিলাম সে ওড়ার এখনো বিরাম নাই।
সেই বয়ঃসন্ধির কাল থেকে কানে আসতে লাগল যে ছবি আঁকলে আর্টিস্ট হওয়া যায় এবং আর্টিস্ট হলে খুব নাম হয়। লোকে আঙুল দেখিয়ে বলে ওই লোকটা খব বড় আর্টিস্ট। পয়সাও নাকি উপায় করা যায়। তবে ওটা বড়লোকদের পেশা, আর্টিস্ট হতে হলে বেশ পয়সাকড়ি খরচ করতে হয়। আবার এ-ও কানে এল যে আর্টিস্টরা খেয়ালি হয়, খাবার পয়সা জোটে না তাদের। তবুও ছবিই আঁকব, আর্টিস্ট হতেই হবে। সেই বয়সেই অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, সাধারণ পড়াশোনা আর করব না। তখনকার দিনে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে পড়তে হলে ম্যাট্রিক না পাস করলেও চলত। এ সংবাদটিও সংগ্রহ করে ফেলেছিলাম। কলকাতা শহরে থাকতাম বলেই এসব খবরাখবর জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল। তা ছাড়া মনটা আমার সেই বয়সেই যেন শিল্পের রসে জারিত হয়ে গিয়েছিল। তবুও মাইনর স্কুল শেষ করে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে ক্যালকাটা মাদ্রাসায় ঢুকতে হয়েছিল। মাদ্রাসার সঙ্গেই ছিল ইংরেজির মাধ্যমে সাধারণ বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা। সেখানে গিয়ে ড্রইং ক্লাস পেয়েছিলাম এবং আজিজার রহমান নামে একজন তরুণ ড্রইং টিচার। তাঁর কাছ থেকেও উৎসাহ এবং উসকানি দুটোই পেয়েছিলাম। যার ফলে সপ্তম শ্রেণি অতিক্রম করে আর অষ্টম শ্রেণিতে যেতে পারিনি বা যেতে চাইনি বলা যায়।
অতএব ১৯৩৮ সালের জুন মাসে কলকাতার চৌরঙ্গীতে গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টে গিয়ে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে এলাম। ফলাফল প্রথম বিভাগেই ছিল। যে ধর্মপ্রাণ পিতা শিশুকালে খেলার ছলে বড় ভাইয়ের স্লেটে আমার হাত আঁকা শিখিয়েছিলেন, সেই নিরীহ মানুষটিকে বাধ্য করেছিলাম আমাকে নিয়ে আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তখন এইটাই নিয়ম ছিল। আব্বা বিরোধিতাও করেননি, আবার উষ্ণতার উত্তাপ দিয়ে সমর্থনও করেননি।
১৯৩৮ সালের জুলাই মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছবি আঁকার অনুশীলন আরম্ভ হয়ে গেল। প্রথম দিকে মনে মনে নিজেকে বিরাট কী ভাবতাম এবং সেইভাবেই চলাফেরা করতাম। রেমব্রান্ট, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল—সব নখের ডগায়। তারপর যত দিন যেতে লাগল, ততই ঘোর কাটতে লাগল। পাঁচ বছরের মধ্যেই কামরুল নামে নতুন এক শিশু হিসেবেই যেন আবার জন্ম নিলাম। এবং সেই থেকে নিউটনের মতোই সমুদ্রতীরের নুড়িপাথর সংগ্রহ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আজ অবধি সেই পাথর স্পর্শ করা তো দূরের কথা, তার আলোর ছটা এখনো দৃষ্টিগোচর হলো না। তবুও হাল ছাড়িনি। ছাড়বই বা কোন সাহসে, পেটে তো আর বিদ্যা নেই। আমার পিতা প্রায়ই আমার ছবি আঁকাকে সমর্থন করার জন্যে যুক্তি দিয়ে বলতেন, ‘ছবি আঁকাও তো হুনুরে কাজ, পেট চলেই যাবে ওর।’ সত্যিই, পেট তো চলেই যাচ্ছে। তাহলে কি পেট চালাবার জন্যে ছবি আঁকছি? এ প্রশ্নের উত্তর কি দেব? না, ছবি আঁকবার জন্যেই ছবি আঁকতে আরম্ভ করেছিলাম বটে, পরে সময় যত যেতে লাগল, ততই মনে নানান প্রশ্নের তাগিদ অনুভব করতে লাগলাম। নিজের ভালো লাগা সেই সঙ্গে অন্যদেরও ভালো লাগানো। এটাতেও যেন প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেলাম না। বয়স বাড়ার সাথে কিছু কিছু রাজনৈতিক চিন্তার আঘাত পড়ল মনের দরজায়। তার মধ্যে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি। সে মানুষ সর্ব সমাজের, বিশেষ করে শোষিত সাধারণ শ্রেণির, নিচের তলার মানুষের আর্তনাদ যেন অধিকতর। কিন্তু শিল্পকলা তো শুনেছি চিত্তবিনোদনের জন্যে! হ্যাঁ তার মধ্যে দিয়েই নতুন বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। আমার ছবির মধ্য দিয়ে ওই কাজটি করতে হবে।