বিল গেটসকে মুগ্ধ করেছেন যে শিক্ষক

তিনি মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা। একসময় ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তবে এখন মানবকল্যাণমূলক কাজের জন্যই আলোচিত বিল গেটস। সম্প্রতি নিজের ব্লগ গেটসনোটসে এক শিক্ষককে নিয়ে লিখেছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

ব্লেয়ার পেনরির সঙ্গে বিল গেটস
ছবি: ইউটিউব থেকে নেওয়া

যখন হাইস্কুলে পড়তাম, প্রিয় ক্লাসগুলোর মধ্যে একটা ছিল ‘নাটক’। যদিও প্রায় জোর করেই এক শিক্ষক নাটকের ক্লাসে আমার নাম লিখিয়েছিলেন। ধরে নিয়েছিলাম, এই ক্লাস একদমই ভালো লাগবে না। কিন্তু অভিনয় আমি ভালোবেসে ফেললাম। নাটক আমার সীমানা বড় করেছে, নতুন কিছু করার সাহস জুগিয়েছে। এমনকি এই সাহসের জোরে অডিশন দিয়েই স্কুলের ‘ব্ল্যাক কমেডি’ মঞ্চনাটকে অভিনয়ের সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলাম।

২০২৪ সালে ওয়াশিংটন রাজ্যের সেরা শিক্ষকের স্বীকৃতি পেয়েছেন ব্লেয়ার পেনরি। নাটকের ক্লাস শিক্ষার্থীদের কতটা বদলে দিতে পারে, তিনি জানেন। নিজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই এই পরিবর্তন দেখেছেন। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আরও সক্রিয় করতে তিনি যেভাবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগান, দেখে আমার মাথা ঘুরে গেছে।

ব্লেয়ার কেন আলাদা

সিয়াটলের দক্ষিণে প্রায় ৩০ মাইল দূরে অবার্ন স্কুল ডিস্ট্রিক্ট। ব্লেয়ার সেখানকার সিটিই (ক্যারিয়ার অ্যান্ড টেকনিক্যাল এডুকেশন) ও চারুকলার শিক্ষক। বেশ কয়েক বছর ধরেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের তিনি বিপণন, পেশার সুযোগ, মনোজগৎ, নাটকসহ নানা বিষয় পড়িয়ে আসছেন।

তবে ব্লেয়ার আলাদা তাঁর অনলাইনে পড়ানোর ধরনের কারণে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে স্কুলগুলো যখন অনলাইন-নির্ভর হয়ে পড়ল, ব্লেয়ার বুঝতে পেরেছিলেন, পুরোনো শিক্ষাক্রম এখানে খাটবে না। মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়া ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের যথেষ্ট সক্রিয় করা যাচ্ছিল না। সেই সময় পুরো স্কুল একই নিয়ম অনুসরণ করছিল। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করছিল, প্রশ্ন করছিল। শিক্ষকেরা নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। সব ঠিক, তবু বাড়িতে বসে পড়ালেখাটা ঠিক যেন হয়ে উঠছিল না।

তখন ব্লেয়ার এক নতুন ধরনের পাঠ্যক্রম তৈরি করেন, যা অনলাইনের সঙ্গে মানানসই। শিক্ষার্থীদের আরও যুক্ত করতে তিনি বিভিন্ন উদ্ভাবনী কৌশল কাজে লাগাতে শুরু করেন।

নতুন চ্যালেঞ্জ

অবার্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৬ ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। তাই ব্লেয়ার তাঁর পাঠের উপকরণগুলো এমনভাবে সাজিয়েছিলেন, যেন তাঁর শিক্ষার্থীরা আরও সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু অনলাইনে ক্লাস চলছিল, টিফিনের সময় কিংবা দুটো ক্লাসের মাঝের বিরতিতে স্কুলের করিডরে দাঁড়িয়ে গল্প করা আর হয়ে উঠছিল না। কিন্তু ব্লেয়ার নিশ্চিত করেছিলেন, হোমরুম সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেন একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা যেন প্রশ্ন করে, আবার নিজেরাই উত্তর দেয়।

আরও পড়ুন

‘চারপাশের সমাজটার কথা মাথায় রেখে আমি আমাদের পাঠ্যক্রম ভেঙে নতুন করে সাজানোর সুযোগ পেয়েছি। এটা আমার নিজের জন্যই একটা দারুণ উপহার,’ ব্লেয়ার বলছিলেন। ‘এই সৃজনশীল চ্যালেঞ্জটা অসম্ভব উপভোগ করছিলাম। এটা আমাকে আরও ভালো শিক্ষক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।’

ব্লেয়ার ও তাঁর সহকর্মীরা যে কাজ শুরু করেছিলেন, সেটাই পরে অবার্ন অনলাইন স্কুলে রূপ নিয়েছে। যদিও ২০২১ সালেই ওয়াশিংটনের স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরেছে, আবার অনেকে অনলাইনেই পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। যারা স্কুলে আসেনি, তাদের একটা বড় অংশই কারণ হিসেবে বলেছে, বাড়িতে করোনার ঝুঁকিতে থাকা বয়স্ক মানুষ আছেন। অবার্ন অনলাইন স্কুল এসব শিক্ষার্থীকেও ভরসা দিয়েছে।

অনলাইনে আনন্দ

অবাক করা বিষয় হলো, এমন অনেক শিক্ষার্থীও অনলাইনে পড়ালেখা চালিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে, যাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে মহামারির কোনো প্রভাব নেই। ব্লেয়ারের মতে, এসব শিক্ষার্থী শুধু যে অনলাইন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, তা নয়; বরং এটিই তাদের সমৃদ্ধ করেছে। কারও কারও হয়তো একটু বাড়তি ছাড় প্রয়োজন ছিল, যেন তারা পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করতে পারে, কিংবা অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে পারে। অনেকে মনে করে, অনলাইনের পড়াশোনার পরিবেশটাই তাদের জন্য সুবিধাজনক। যেমন সে হয়তো ঘরে নির্জনতায় বসে ক্লাসে ভালো মন দিতে পারে। আবার কেউ হয়তো পুরো ক্লাসের সামনে হাত উঁচু করে প্রশ্ন করার চেয়ে চ্যাটবক্সে লিখে প্রশ্ন করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

কিছু শিক্ষার্থী এই দূরশিক্ষনেই বরং আগের চেয়ে ভালো করছে, জেনে সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। আরও অনেকের মতো আমিও ভেবেছিলাম, অনলাইনের পড়ালেখা হলো সাময়িক সময়ের জন্য বাধা পেরোনোর একটা উপায়। কিন্তু ব্লেয়ার এটাকে দেখছেন একটা মস্ত সুযোগ হিসেবে। যে সুযোগ সমতা নিশ্চিত করার একটা বড় মাধ্যম হতে পারে।

অনলাইনে নাটকের ক্লাস

ব্লেয়ার কীভাবে অনলাইনে নাটকের ক্লাস নেন, শুনে মুগ্ধ হয়েছি। ‘একটা ব্যাপার বেশ মজার। সরাসরি ক্লাস না হলে শিক্ষার্থীরা অনেক নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারে। ক্লাসরুমের সব কটি চোখ যখন তাঁর দিকেই নিবিষ্ট থাকে, তখন হয়তো সে সেটা পারে না,’ ব্লেয়ার বলেন। যেমন তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেন। নিজের সংলাপগুলো শিক্ষার্থীরা একা বাসায় বারবার চর্চা করে, নিজের অভিনয় নিজেই ভিডিও করে। যতক্ষণ না নিখুঁত হচ্ছে, অন্যের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার যোগ্য হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁরা চর্চা চালিয়ে যায়।

‘কিছু শিক্ষার্থী নাটকের ক্লাস করতে চায় না,’ ব্লেয়ার বলছিলেন। ‘কিন্তু যখনই আপনি তাকে আশ্বস্ত করবেন, “তোমাকে মঞ্চে উঠতে হবে না”, তখনই সে অন্য কোনো উপায়ে নিজের সৃজনশীলতা আবিষ্কারের পথ পেয়ে যায়, যা হয়তো সে আগে জানতই না।’

ব্লেয়ার স্পষ্ট করেই বলছেন, অনলাইন শিক্ষা সবার জন্য নয়। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, কোনো কোনো পরিবারের জন্য একটা বিকল্প উপায়ই অনেক বড় সুযোগ। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত