শুশুক দিয়ে মাছ শিকার
শীতলক্ষ্যার ওপারে সবুজ দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষসারির আড়ালে টকটকে লাল সূর্যটা একটু আগে হারিয়ে গেছে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে সন্ধ্যার আঁধার। ঠিক সে সময় কোষা নৌকার ওপর উঠে বসলেন দুই আলী ভাই—হজরত আর আরজু। গলুইয়ের ওপর ঝুলিয়ে দেওয়া হলো হ্যাজাক, বাতির মাথায় টিনের ঢাকনা দিয়ে দেওয়া হলো, আলোটা যাতে সরাসরি পানির ওপর পড়ে।
হজরত টেঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন গলুইয়ের কাছে। কোষার পেছন দিকে আরেক ভাই আরজু তখন নিজের বইঠাটা দিয়ে পানিতে পরপর কয়েকটা আঘাত করলেন। ঠিক তখনই দূরের জলে আলোড়ন তুলে দুটি জলজ প্রাণী নৌকার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। নদীর ধার ঘেঁষে অন্ধকার ভেদ করে চলতে লাগল কোষা। আরজু দাঁড় বাইছেন আর জ্বলন্ত হ্যাজাকের ঠিক ওপরে টেঁটা হাতে সতর্ক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন হজরত। হ্যাজাকের আলোয় জলের নিচটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ছোট–মাঝারি মাছ দেখা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেঁটায় বিদ্ধ করে নৌকায় তুলে আনছেন। এদিকে পেছনের প্রাণী দুটি একইভাবে এগিয়ে চলেছে নৌকার পেছন পেছন। মাঝেমধ্যে ওরা গভীর পানির দিকে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে নৌকার কাছে। আচমকা বিশাল এক আইড় মাছ এসে আশ্রয় নিল হ্যাজাকের আলোর বৃত্তে। সেটাকে টেঁটাবিদ্ধ করে নৌকায় তুলে আনলেন হজরত। তারপর নৌকা থেকে মাঝারি আকৃতির কিছু মাছ ছুড়ে দিলেন প্রাণী দুটির উদ্দেশে। মাছ খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আবার ছুটে গেল গভীর জলের দিকে।
অনেকে হয়তো ভাবছেন, কোষা নৌকার পেছনে জলের নিচ দিয়ে ছুটে চলা প্রাণী দুটির পরিচয় কী? আসলে এরা হচ্ছে আমাদের দেশের মিঠাপানির একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী। শুশুক কিংবা শিশু নামে পরিচিত। ইংরেজিতে এদের বলা হয় রিভার ডলফিন বা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Platanista gangetica। দেশের প্রায় সব নদীতেই একসময় শুশুক দেখতে পাওয়া যেত। সুরমা রঙের এই জলজ প্রাণীটি লম্বায় ১০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে, যদিও ১৩ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা শুশুক ধরা পড়ার রেকর্ডও রয়েছে। এদের দেহের আকৃতি অনেকটা টর্পেডোর মতো। তাই পানির নিচ দিয়ে ওরা দ্রুত ছুটতে পারে।
শুশুক দক্ষ শিকারি। এদের শিকার তালিকায় ছোট মাছের পাশাপাশি বড় আকৃতির কাতল, রুই, বোয়াল, আইড় ইত্যাদিও রয়েছে। অনেক সময় এদের তাড়া খেয়ে বড় বড় মাছ প্রাণ বাঁচাতে জল ছেড়ে ডাঙায়ও চলে আসে। এমনিতে শুশুক বুদ্ধিমান ও শান্ত স্বভাবের প্রাণী। দেহের তুলনায় এদের চোখ কিন্তু খুবই ছোট, মাথার অগ্রভাগে রয়েছে লম্বা একটি ঠোঁট। ওপর এবং নিচের চোয়ালে রয়েছে ৩৩ জোড়া করে দাঁত। নদীতে একটা নির্দিষ্ট সীমানাজুড়ে এরা জোড়ায় বাস করে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে নিজের সীমানা অতিক্রম করে না। মেয়ে শুশুক বর্ষাকালে এক থেকে দুটি বাচ্চা প্রসব করে থাকে। এরা যেসব নদীতে বসবাস করে, সেসবের তীরে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই এদের দেখা পাওয়া যায়। একটু পরপর শ্বাস নেওয়ার জন্য জলের ওপর ভেসে ওঠে। আর শ্বাসগ্রহণের সময় ‘হুম’ বা ‘হুশ’ বলে একধরনের শব্দ করে। এ জন্য অনেক জায়গায় এরা ‘হুমমাছ’ নামেও পরিচিত।
নরসিংদী জেলার চরসিন্দুর অঞ্চলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী কিছু মানুষের কাছে শুশুক এক পরম বন্ধু। এরা মাছ শিকারে ওদের সহায়তা নিয়ে থাকে। প্রায় দুই দশক আগে বিষয়টি প্রথম জানতে পারি। শীতলক্ষ্যা তখন নানা জাতের মাছ আর বিচিত্র সব জলজ প্রাণীতে সমৃদ্ধ এক নদী। এখানে–সেখানে শুশুকও দেখতে পাওয়া যেত প্রচুর। গ্রামাঞ্চলে তখন খোলাবাজারে শুশুকের তেল বিক্রি হতো। লোকজনের ধারণা ছিল, এই তেল বাত রোগের মহৌষধ। একশ্রেণির লোক রাতের অন্ধকারে শুশুক শিকার করে কবিরাজদের কাছে বিক্রি করত। জালে আটকা পড়া শুশুক জলে না ছেড়ে ডাঙায় এনে ফেলত জেলেরা, এভাবে নিছক অবহেলার কারণে মারা পড়ত অনেক শুশুক। তা ছাড়া স্থানীয় দুটি সার কারখানার অ্যামোনিয়া বর্জ্যেও শুশুকদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছিল। প্রায়ই মরে ভেসে উঠত শুশুক আর শুশুকের বাচ্চা। শুশুকদের রক্ষায় এগিয়ে আসে স্থানীয় একটি সংগঠন। শুশুক রক্ষায় নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। কারখানার দূষণরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
সেই অসাধারণ মানুষগুলোর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কিছু লোকের সঙ্গে পরিচয়, গভীর জলের শুশুক যাদের কাছে বন্ধুর মতো। ওরা পানিতে বইঠা দিয়ে আওয়াজ করার সঙ্গে সঙ্গে শুশুক চলে আসে তাদের নৌকার কাছে। ওদের সাহায্য নিয়ে তারা মাছ শিকার করে। ডলফিনরা এমনিতে খুব বুদ্ধিমান, এদের নিয়ে সাগরে নিমজ্জিত হতে যাওয়া মানুষকে উদ্ধারের গল্প রয়েছে। কিন্তু এ দেশে পোষা উদবিড়াল দিয়ে মাছ শিকারের চল থাকলেও শুশুকের সাহায্য নিয়ে মাছ শিকারের ঘটনাটা একেবারেই নতুন। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বহু কাল ধরে শুশুকেরা ওদের মাছ শিকারে সহায়তা করে আসছে। মানুষের সঙ্গে নদীর ডলফিনের এই সখ্যে অবাক না হয়ে পারলাম না।
কিছুদিন আগে এ বিষয়ে লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি। সে উদ্দেশ্যই প্রখ্যাত বন্য প্রাণিবিশেষজ্ঞ মো. আলী রেজা খানের সঙ্গে কথা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মনিরুল খানকেও বিষয়টি অবহিত করি। দুজনই এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আসলে এই বিরল ঘটনা নিয়ে অবশ্যই গবেষণার প্রয়োজন।
লেখাটি লিপিবদ্ধ করার সময় আবার হজরত আলীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। শুশুকবন্ধু মানুষটি আক্ষেপ করে বললেন, ‘কারখানার বিষে নদীর জল দূষিত হইয়া গেছে, আগের মতো মাছও নাই, শিশুও নাই। তবুও শীতের সময় পানি পরিষ্কার হইলে শিশু দিয়া মাছ মারার চেষ্টা করি।’
হজরত আলীর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এক বিপন্ন প্রাণীর বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, এক বিরল জীবিকারও কি অবসান ঘটতে চলেছে?