সদ্য আর কোনোদিন সালামি চাইবে না
গত ঈদুল ফিতরেও সাভারের বাড়িটা মাতিয়ে রেখেছিল সাফওয়ান আখতার সদ্য। এবার তাকে ছাড়া বাড়িজুড়ে শুধুই হাহাকার। ৫ আগস্ট সরকার পতনের খবরে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে বেরিয়ে প্রাণ হারায় স্কুলছাত্র সদ্য। ছেলেকে একমুহূর্ত ভুলতে পারেন না মা খাদিজা বিন জোবায়েদ
রোজার দুই দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করত সদ্য। চুল কাটত, জায়নামাজ ধুয়ে ঝকঝকে করে তুলত আর নতুন টুপি কিনত। পুরোনো টুপি দিয়ে সে কখনো রমজান শুরু করত না—কত আগ্রহ, কত উচ্ছ্বাস! আমাকে তাড়া দিয়ে বলত, ‘মা, বাজারে যাবে না? গরুর মাংস কিনবে না! আমি কিন্তু গরুর মাংস ছাড়া সাহ্রি খাব না।’
ছেলের এই আবদার শুনে ওর বাবাও হাসিমুখে গরুর সামনের একটা আস্ত রান নিয়ে আসত। সদ্য তখন খুশিতে ডগমগ হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলত, ‘বাবা, তুমি অনেক ভালো বাবা।’
পরে আমার কাছে এসে উচ্ছ্বাসে বলত, ‘মা, গরুর মাংস তো অনেক আনছে বাবা, তুমি তাহলে ভুনা খিচুড়ি রান্না করো সাহ্রির জন্য।’
আমি হেসে বলতাম, ‘বাবা, ভুনা খিচুড়ি সাহ্রিতে খায় না, আমি এখনই রান্না করে দিচ্ছি।’ এই কথা শুনে আমার বাবাটা কতই না খুশি হতো।
রোজা রেখে রান্নাঘরে তার যাওয়া-আসা ছিল অবিরাম। বারবার রান্নাঘরে উঁকি দিত, খুশি হয়ে পায়চারি করত। আসরের আজানের পর শিশুর মতো এসে বলত, ‘মা, ক্ষুধা লাগছে!’
আমি তাকে বুঝিয়ে বলতাম, ‘বাবা, রোজা রেখে এ কথা বলতে হয় না।’
তার পর থেকে আর কখনো মুখ ফুটে কিছু বলত না। আমার ছোট্ট ছেলেটা এতটুকুতে বুঝে যেত। কিন্তু আমি জানতাম, আমার বাবাটা কত কষ্ট পাচ্ছে!
ইফতারের এক ঘণ্টা আগে থেকেই সে শরবত বানাত, টেবিল সাজাত। সবকিছু নিজের হাতে গুছিয়ে শেষে বলত, ‘মা, রাইনকে দোতলা থেকে ডেকে নিয়ে আসি, একসঙ্গে ইফতার করব?’ আমার সায় পেয়ে চলে যেত তাকে আনতে।
ঈদের কয়েক দিন আগ থেকেই সে শুরু করত—‘মা, ঈদের দিনে কী বানাবে বলো?’
আমি হেসে বলতাম, ‘প্রতিদিন তো ভালো ভালো খাবার খাচ্ছ, ঈদের দিন আবার কী বানাব? এগুলোর মধ্যে থেকেই একটা করে দিই।’
তখন সে চোখ বড় বড় করে বলত, ‘দাদাবাড়ির ঐতিহ্য রাখতে হবে! তুমি পিঠালি রান্না করবে, বড় পাতিলে। সবাই মিলে খাব, কত মজা হবে!’
ছেলেটার উৎসাহ দেখে আমার মন ভরে যেত।
গত ঈদের দিন সকাল থেকে তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সালামি সংগ্রহ করা। ঘরে ঘরে গিয়ে সালাম করত, খুশি হয়ে টাকাগুলো গুনত। এমনকি ছোট্ট তিশমাও রেহাই পায়নি, ‘আপি, তুমি ১০ টাকা হলেও দাও, তবু দিতে হবে!’
এভাবে সে ৮৫০ টাকা জোগাড় করেছিল। সেদিন এত খুশি হয়েছিল যে পুরো ২০ মিনিট লাফিয়ে বেরিয়েছে আর বলেছে, ‘সামনের ঈদে দুই হাজার টাকা তুলব! তারপর সবাই মিলে খাব!’
কিন্তু সামনের ঈদের আগেই তুমি চলে গেলে। বাবার বাড়িতে গেলে, এমন সাজে যে সবাই তোমাকে দেখতে এল। কিন্তু কেউ আর সালামি দিল না। খালি হাতে শুধু একবার স্পর্শ করে বিদায় জানাল। সে এবার খালি হাতেই ফিরে গেল। আমিও শূন্য হাতে রইলাম—শূন্য বুক, শূন্য চোখ, শূন্য মন নিয়ে। সেই আনন্দ, সেই হাসি, সেই উচ্ছ্বাস—সব যেন তোমার সঙ্গে চলে গেছে।
গত ঈদে তোমার মুখের হাসি দেখে মনে হয়েছিল, এই তো জীবনের সুখ! এবার জীবনটা যেন থমকে গেছে। তোমার স্মৃতি, তোমার হাসি, তোমার কথাগুলোই এখন আমার সঙ্গী।