আমরা যাঁরা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি, তাঁদের অনেকের শৈশব ছিল এমনই

সংগ্রহের কমিকস বইগুলোছবি: লেখক

আমরা যাঁরা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি, ছোটবেলায় তাঁদের অনেকের ঘরে টেলিভিশন ছিল না, কম্পিউটার ছিল না, ছিল না ইন্টারনেট, খবরের কাগজ, টেলিফোন। তবে আমাদের ছিল গল্পের বইয়ের ভান্ডার। ছিল ঠাকুরমার ঝুলি, বীরবলের গল্প, ঈশপের রূপকথা, রাক্ষস-খোক্ষস আর আলিবাবা চল্লিশ চোর

আমরা আলাদিনের ম্যাজিক কার্পেটে ঘুরতাম, ম্যাকগাইভারের মেধা দেখে মুগ্ধ হতাম, হারকিউলিসের শক্তি, সিন্দাবাদের অ্যাডভেঞ্চার দেখে শিহরিত হতাম, টম অ্যান্ড জেরি দেখে হেসে কুটি কুটি হতাম। কল্পকথা, রূপকথা আর উপকথার রঙিন শব্দগুলো যেদিন থেকে বই আকারে সামনে এল, সেদিন থেকেই সেগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। একালের ছেলেমেয়েরা টিফিনের টাকা জমিয়ে কী কেনে জানি না, আমরা বই কিনতাম। একসময় চোখের সামনে এল কমিকসের দুনিয়া—সে কী দিন ছিল রে! টিফিনের দুই টাকা করে জমিয়ে জমিয়ে একটা ‘চাচা চৌধুরী’ ছিল ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ পাওয়া।

সাবু আর রাকার ওপেন চ্যালেঞ্জ জানার জন্য লাইব্রেরিতে মারামারি বাধিয়ে দিত স্কুলের সবচেয়ে শান্ত ছেলেটা। রাস্তায় যেকোনো কুকুরকে বসে থাকতে দেখলে চুপটি করে তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ত কুকুরকে সবচেয়ে বেশি ভয় পাওয়া ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো ভিতু বালকটা, চোখের ফ্রেমে বন্দী হয়ে যাওয়া সেই এক মুহূর্তেই স্কুলে সে হয়ে যেত বীর টিনটিন! একটু বিল্লু হওয়ার জন্য কেউ কেউ চুলগুলো সামনে এনে লেপটে দিত, কিংবা শীতের চাদরটা গোল করে পাগড়ি বানিয়ে হয়ে যেত চাচা চৌধুরী…রকেট, কুট্টুস, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, নন্টে ফন্টের রঙিন জগতের কাছে এক ফুৎকারে উড়ে যেত সেকালের বাঘা বাঘা সব নাটক–সিনেমা!

আমাদের বাসায় কম্পিউটার না থাকলেও আমরা জানতাম চাচা চৌধুরীর মগজ কম্পিউটারের চাইতে প্রখর, সৌরজগৎ সম্পর্কে আমাদের কোনো বাস্তব জ্ঞান না থাকলেও আমরা রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা উজ্জ্বল তারাটার দিকে আঙুল তাক করে বন্ধুদের বলতাম, দেখ দেখ ওই জুপিটারে সাবুর বাড়ি, এ জন্যই সে এত বিশাল! আমাদের সকালে নাশতার হিসাব না থাকলেও আমরা জানতাম সাবু রোজ সকালে ৫০-৬০টা লুচি খায়; লস্যি কী জিনিস কখনো চোখে দেখিনি, কিন্তু সাবু লস্যি খায় বলে ঈদের দিনে মায়ের কাছে লস্যি বানানোর গোঁ ধরে বসতাম! দুনিয়ার কোথাও যদি অগ্নুৎপাতের খবর পেতাম, আতঙ্কে হায় হায় করে উঠতাম, সাবু রেগে গেছে! কারণ সাবু রেগে গেলেই তো পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হয়!

আমার মতো অনেকেরই শৈশব ছিল এমনই ঘোর লাগানো, আমাদের দুনিয়া ছিল এমনই অ্যাডভেঞ্চারের রঙে মাখানো। আমরা রাত সাড়ে আটটা বাজলেই বই বন্ধ করে টেলিভিশনের সামনে বসে পড়তাম, আমাদের নব্য চোখে তখন হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত আরব্য রজনীর বিশাল নীল দৈত্য, কোথাকার কোন কোহকাফ নগরীর বন্দী পরিদের জন্য হু হু করে কেঁদে উঠত আমাদের মন! স্কুলে-কলেজে বইয়ের ভেতরে, ব্যাগের কোনায়, প্যান্টের পকেটে কিংবা ইন করা জামার ভেতরেও অনায়াসে খোঁজ মিলত কুট্টুস আর রকেটের রঙিন কমিকস! মা-বাবা ঘরের বাতি নিভিয়ে চলে গেলেই আমাদের অনেকের ঘরে জ্বলে উঠত টর্চ বা মোমের আলো! যাঁদের কমিকস কেনার সামর্থ্য ছিল না, তাঁরা লাইব্রেরি থেকে দুই টাকা দিয়ে ভাড়া আনতাম; গোলাপের ওপর যেমন খুব সাবধানে হাত বোলায় মানুষ, ঠিক তেমনই আলতো করে কমিকসের পাতা উল্টাতাম আমরা; একটুও যেন নষ্ট না হয়, একটা ভাঁজও যেন না পড়ে সাবুর গায়ে, এক ফোঁটাও যেন এলোমেলো না হয় বিল্লুর চুল, পিংকির স্কার্ট!

অনেক দিন হলো কমিকস ছেড়েছি, কিন্তু তাই বলে ওই আবেগ, ভালোবাসা, রোমাঞ্চটুকু ছাড়তে পারিনি। সে সময়ে প্রকাশিত সব কটি কমিকসের বই কিনে জমিয়েছিলাম, একসময় সব কটি হারিয়েও ফেলি। এত বছর পরে এ বয়সে এসে নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান, অনলাইনের এই পেজ-সেই পেজ, কমলাপুর স্টেশনের ফুটপাথ, চট্টগ্রামের রেললাইনের অলিগলি, খুলনার নিউমার্কেটের এতলা-ওতলা খুঁজে আর সিলেটের বাসের ভেতরে হকারের কাছ থেকে রীতিমতো ছিনিয়ে নিয়ে আবার সংগ্রহ করেছি আমাদের হারিয়ে যাওয়া বর্ণিল শৈশব! প্রতিটি বইয়ের গায়ে এখনো লেগে আছে আমাদের স্বপ্নের গন্ধ! এই বইগুলো পুরোনো হতে পারে-কিন্তু এদের ঘিরে গড়ে ওঠা আবেগ, ভালোবাসা, মুহূর্তগুলো কখনো পুরোনো হবে না...।