স্বনামধন্য ব্যক্তির নাম ভাঙিয়ে যেভাবে প্রতারণা চলছে, এসব এড়াতে যা করবেন

স্বনামধন্য ব্যক্তির নাম ভাঙিয়ে প্রতারণাকে প্রযুক্তির ভাষায় বলে ‘স্পুফিং’। কারও পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণার চল অনেক দিনের। আগে ল্যান্ডফোনের আমলে এমন প্র্যাংক কলের উপদ্রব ছিল। স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ার পর এসব আরও বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে চট করে প্রতারণা ধরে ফেলাও হয়ে গেছে কঠিন। গত কয়েক বছরে, বিশেষত গত কয়েক মাসে এমন প্রতারণার মুখে পড়েছেন অনেকেই। চারজন ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি জেনে রাখুন এমন পরিস্থিতিতে কী করবেন।

স্বনামধন্য ব্যক্তির নাম ভাঙিয়ে প্রতারণাকে প্রযুক্তির ভাষায় বলে ‘স্পুফিং’ছবি: পেক্সেলস

কেস স্টাডি ১

দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান। একদিন তিনি তাঁর এলাকার এক শিল্পপতির নামে ফোনকল পান। সেই শিল্পপতি দূরের এক হোটেলের বিল দিতে পারছিলেন না বলে বিকাশ করতে বলেন। মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রথমে প্রতারক খুব স্বাভাবিকভাবে শিল্পপতির পরিচয় দিয়ে কথা বলে। বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেয়। তারপর শিল্পপতির পিএস পরিচয় দিয়ে একজন ফোন করে বলে, ‘স্যারকে ২৫ হাজার টাকা পাঠাতে বলছেন, স্যারের ক্রেডিট কার্ড কাজ করছে না। ২৫ হাজার টাকা দিলে আগামীকাল ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেবেন।’ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে বিশ্বাস করলেও পরে টাকার কথা শুনে বিশ্বাস রাখতে পারিনি।’ মোস্তাফিজের মতো এমন অনেকেই মুঠোফোনে স্বনামধন্য বা পরিচিত ব্যক্তির নামে ফোনকল পাচ্ছেন এবং কেউ কেউ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এতে আর্থিক ক্ষতি থেকে শুরু করে অনেক ধরনের সমস্যাতেই পড়ার খবর শোনা যাচ্ছে।

কেস স্টাডি ২

মো. আবুল হোসেন খান অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ। ২৮ জানুয়ারি তাঁকে পরিচিতজনের নামে এক ব্যক্তি ফোন করে ওয়ান টাইম পিন চায়। আবুল হোসেন পিন দিয়ে দেন। তারপর প্রতারক তাঁর স্মার্টফোন হ্যাক করে ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে পরিচিতদের কাছে টাকা চাইতে শুরু করে। এখন আবুল হোসেনের মেয়ে বেনজির আনজুম সবাইকে ফোন করে করে সতর্ক করে দিতে ব্যস্ত।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা বেনজির আনজুম বলেন, ‘এমন প্রতারণার মুখে যদি আমার বাবা পড়েন, তখন কেমন লাগে! আমার বাবা সাবেক জেলা ও দায়রা জজ, তিনিই পড়েছেন প্রতারকের খপ্পরে! সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলব। সচেতনতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের প্রতারণার হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে। প্রতারিত হয়ে আমার বাবার এখন কথা বলার অবস্থা নেই।’

আরও পড়ুন

কেস স্টাডি ৩

মূর্ছনা বিশ্বাস কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তাঁকে একদিন সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত এক ঔপন্যাসিকের নামে ফোন করেন এক ব্যক্তি। পছন্দের ঔপন্যাসিকের ফোন পেলে কার না ভালো লাগে! মূর্ছনাকে মাঝেমধ্যেই ফোন করেন সেই ‘বিখ্যাত ঔপন্যাসিক’। প্রথম দিকে সব বিশ্বাস করে কথা বলছিলেন মূর্ছনা। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সেই ‘ঔপন্যাসিক’ সিলেটে এক উৎসবে গিয়ে বিপদে পড়েন। মূর্ছনাকে ফোন করে ১০ হাজার টাকা মুঠোফোনে পাঠাতে বলেন। মূর্ছনা ১০ হাজার টাকা ও সঙ্গে টাকা তোলার ২০০ টাকাও পাঠিয়ে দেন। এরপরের ঘটনা সম্পর্কে মূর্ছনা বলেন, ‘লেখক আমাকে বিকেলে দ্রুত টাকা পাঠাতে বলেন। তখন তাঁর বিপদের কথা চিন্তা করে টাকা পাঠিয়ে দিই। সন্ধ্যায় খোঁজ নিতে ফোন করলে দেখি, নম্বর বন্ধ। এরপর আর কোনো দিন সেই নম্বর খোলা পাইনি। গত বছর বইমেলায় সেই ঔপন্যাসিকের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তখন বুঝলাম, আমার ১০ হাজার টাকা অন্য কেউ নিয়ে গেছে! এসব প্রতারণার হাত থেকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।’

কেস স্টাডি ৪

এমন প্রতারণার চেষ্টা করা হয় চিকিৎসক এজাজ বারী চৌধুরীর সঙ্গেও। ঘটনাটি তিনি প্রকাশ করেছেন ফেসবুকে। তাঁকে এক চিকিৎসকের নাম করে প্রতারক চক্র ফোন করে। এজাজ বলেন, ‘ওই প্রতারক এক রোগীর কথা বলে আমার কাছ থেকে টাকা চায়। রোগী মারা যাওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার চেষ্টা করে। বিভিন্ন তথ্য যাচাই করার পর নিশ্চিত হই, আমার সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করেছিল।’

ডা. এজাজ বারী চৌধুরীর কিছু পরামর্শ—

  • যে কেউ ফোন করে যেকোনো পরিস্থিতির কথা বলে টাকা চাইলে সতর্ক থাকুন।

  • মুঠোফোনে টাকা চাওয়ার ক্ষেত্রে যতই পরিচিত হোক না কেন, সতর্ক থাকুন।

  • অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে তা যাচাই করুন। বিশেষ কিছু অ্যাপে যাচাই করে দেখুন, নম্বরটি আসলে কার।

  • অনেক পেশাজীবীর নাম ভাঙিয়ে প্রতারকেরা ফোন করে। পেশাজীবীরা সাধারণত একই নম্বর অনেক বছর ধরে ব্যবহার করেন, তাই তাঁদের নম্বর সহজেই যাচাই করা যায়।

  • কেউ ফোন করে টাকা চাইলে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর চান। নতুন মোবাইল নম্বর সহজে পাওয়া গেলেও ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলা অত সহজ নয়। ফলে প্রতারকেরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর সচরাচর দিতে চায় না বা পারে না।

আরও পড়ুন

বিশেষজ্ঞ যা বললেন

অনেক সময় প্রতারকেরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বনামধন্য যে কারও কণ্ঠ নকল করতে পারে। কখনো কখনো বিখ্যাত ব্যক্তি বা আপনার পরিচিত কারও পরিচয়ও ব্যবহার করে। সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান বলেন—

  • এসব ক্ষেত্রে প্রথমেই ফোনকল যাচাই করুন। ফোনকল যাচাইয়ের জন্য ‘ট্রু কলার’ নামের একটি অ্যাপ আছে, তা ব্যবহার করতে পারেন। এই অ্যাপে বিভিন্ন নম্বরের মালিকের নাম ও তথ্য অনেক সময় জানার সুযোগ থাকে।

  • অপরিচিত যেকোনো নম্বর থেকে ফোন এলে সতর্ক থাকুন। প্রতারক ব্যক্তি পরিচিত নাম বললেও সরাসরি বিশ্বাস করবেন না। পরিচিত ব্যক্তির কথা বললেও তার পরিচয় নিশ্চিত করুন। অনেক সময় সরাসরি প্রশ্ন বা ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্ন করে পরিচয় যাচাই করা যায়।

  • হঠাৎ করে টাকা কিংবা কোনো সাহায্য চাওয়া বা জরুরি সাহায্যের অনুরোধ করলে সতর্ক থাকুন। যেকোনো ধরনের প্রতারণা চিহ্নিত করার কৌশল সম্পর্কে জানুন।

  • কিছু ক্ষেত্রে কণ্ঠে যান্ত্রিকতা, অস্বাভাবিকতা খেয়াল করতে পারেন। কলের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক বিরতি বা যান্ত্রিক মনে হলে সতর্ক থাকুন। যেকোনো ধরনের অনুরোধ বা তথ্য চাইলে দেবেন না।

ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় যা করবেন

  • অনলাইন যেকোনো প্রতারণার বিরুদ্ধে সবার আগে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা কোনো ফোরামে ব্যক্তিগত তথ্য (ফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট নম্বর, ঠিকানা) প্রকাশ এড়িয়ে চলুন।

  • গোপনীয়তা সেটিংস আপডেট করে ব্যক্তিগত তথ্য লুকিয়ে ফেলুন। খুব সতর্কতার সঙ্গে জন্মতারিখ, শিক্ষা ও কর্মস্থলের তথ্য সীমিত রাখুন।

  • সব অ্যাকাউন্টে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ও সব ধরনের অনলাইন নিরাপত্তাব্যবস্থা ব্যবহার করুন।

  • কখনোই সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট বা লিংকে ক্লিক করবেন না। প্রতারকেরা ফোন করে অনেক অনুনয়বিনয় করতে পারে ক্লিক করার জন্য, সতর্ক থাকুন।

  • অপরিচিত লিংকে ক্লিক করার আগে যাচাই করুন। ই–মেইল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সন্দেহজনক মেসেজ পেলে সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্মে রিপোর্ট করুন।

  • পরিচিত কারও কাছ থেকে অস্বাভাবিক বার্তা পেলে তাঁদের সঙ্গে মুঠোফোনে সরাসরি যোগাযোগ করুন বা কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

  • প্রতারণার ঘটনা ঘটলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করুন। থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করুন। সংশ্লিষ্ট মুঠোফোন নম্বর ও ব্যক্তির তথ্য দিয়ে জিডি করুন।

আর্থিন লেনদেনের সময় যা মনে রাখবেন

  • ফোনে কেউ টাকা চাইলেই আর্থিক লেনদেন করবেন না।

  • কখনোই ওটিপি, ব্যাংক তথ্য বা ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করবেন না।

  • কোনো লেনদেনের আগে কলারের পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে টাকা পাঠাবেন না।

  • অপরিচিত নম্বর ফোন করা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় কল রেকর্ড করার সুযোগ থাকলে রেকর্ড করুন। প্রমাণ সংরক্ষণ করতে চেষ্টা করুন।

  • কল রেকর্ড করুন, মেসেজ সংরক্ষণ করুন, স্ক্রিনশট নিন। এ ধরনের প্রতারণার মুখে পড়লে পরিচিতজনদের সতর্ক করুন।

  • সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতারকের নম্বর বা কৌশল সম্পর্কে জানিয়ে পোস্ট দিয়ে রাখুন।

  • আপনার পরিচিতি বা কণ্ঠ কেউ নকল করলে তা দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পরিচিত মহলে জানান। কণ্ঠ নকল বা ডিজিটাল প্রতারণা সম্পর্কে নিজে সচেতন থাকুন এবং অন্যদেরও সচেতন করুন।

আরও পড়ুন