বয়স ৩৩, স্নাতক ডিগ্রি নেই, ঘরে বসে বছরে আয় করেন ১ লাখ ডলার
ডি’অড্রা অ্যান্সলির বয়স ৩৩, স্নাতক ডিগ্রি নেই। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল টেক্সাসের একটি রিয়েল এস্টেট ফার্মের প্রোডাক্ট ম্যানেজার। কাজ করেন তাঁর হিউস্টনের বাসা থেকে। বছরে আয় এক লাখ ডলারের বেশি। অ্যান্সলি কীভাবে স্নাতক ডিগ্রি ছাড়াই এত ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারলেন?
ডি’অড্রা অ্যান্সলি কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি, তিনি প্রযুক্তি খাতে কাজ করবেন। তাঁর ভাবনার জগৎটা পাল্টে যায় ২০০০ সালের একদিন। যেদিন তাঁর বড় ভাই ডি’আর্কি চোখের সামনে তাঁদের ছোট্ট বাসার মেঝেতে নিজের কম্পিউটারটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলেন। ডি’আর্কি ছিলেন টেক্সাসের অস্টিনের হিউস্টন-টিলোটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞানের ছাত্র। ক্লাসের একটা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করছিলেন তিনি। মাথাটা সেদিন বোধ হয় গরম হয়ে গিয়েছিল বলেই অমন তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়েছিলেন!
সহস্রাব্দের শুরুর দিককার সে সময় অ্যান্সলিদের এলাকায় ঘরে ঘরে এখনকার মতো কম্পিউটার ছিল না। অ্যান্সলির বয়স তখন ১০ বছর। মেঝেতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা কম্পিউটারের তার ও মাইক্রোচিপগুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন তিনি।
‘মনে হচ্ছিল, ওসব (কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ) যেন একটা ধাঁধা। জানতে চাইছিলাম, কীভাবে কম্পিউটারের একটি অংশের সঙ্গে অন্যটি যুক্ত থাকে। ঠিক তখনই আমি প্রযুক্তির প্রেমে পড়ে যাই,’ এভাবেই স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন ৩৩ বছর বয়সী অ্যান্সলি।
আর ওই সময় থেকেই অ্যান্সলি তাঁর বড় ভাইকে অনুসরণ করতে শুরু করেন। ২০০৮ সালে অ্যান্সলি ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। কিন্তু মাঝপথে ছেড়ে দেন পড়াশোনা। কারণ, বিষয়টা তাঁকে আর টানেনি।
‘আমার মনে হতো, প্রযুক্তি খাতে কাজ করতে হলে যেসব বিষয়ে দক্ষতা প্রয়োজন, আমি ক্লাসে হাতে-কলমে সেসবের কিছুই শিখতে পারছি না। তখন আমি শুধু ভাবতাম, স্নাতক ডিগ্রি ছাড়া কত দূর যেতে পারব?’
আমি কখনো ‘না’ শুনে আশাহত হইনি
অ্যান্সলি প্রথম চাকরিতে যোগ দেন টেক্সাসের অস্টিন শহরের ‘বিএমএফ’ নামে একটি কোম্পানিতে। বিএমএফ মূলত ক্রিয়েটিভ মার্কেটিং এজেন্সি। অ্যান্সলি তাঁর জীবনবৃত্তান্তে নিজের ‘সফট স্কিলগুলো’ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন। যেমন যোগাযোগদক্ষতা, নেতৃত্ব দেওয়া, সময় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। ছাত্রজীবনে তিনি যেসব স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ ও খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন, সেসবও উল্লেখ করেছিলেন।
বিএমএফে চাকরিরত অবস্থায় অ্যান্সলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় শিখেছিলেন, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে প্রোডাক্ট ম্যানেজার হতে সহায়তা করেছে। বিষয় দুটি হলো সমস্যা সমাধান করা এবং দলগতভাবে যৌথ প্রচেষ্টায় কাজ করা।
অ্যান্সলি বলছিলেন, ‘অনুষ্ঠান সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল আমার। সেসব আয়োজনে শত শত মানুষ অংশ নিতেন। আমাকে সব সময় নিশ্চিত করতে হতো, আমার সহকর্মী, ভেন্ডর, ক্লায়েন্ট—প্রত্যেকে নিজেদের কাজ ঠিকমতো করছেন এবং সন্তুষ্ট আছেন।’
অ্যান্সলি জানতেন, এই ক্ষেত্রটিতে তিনি অনেকের চেয়েই ভালো করবেন, তবে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তাঁকে অসাধারণ কিছু দক্ষতা অর্জন করতে হবে, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে হাতে–কলমে।
অ্যান্সলির ভাষায়, ‘ছুটির দিনে পার্টি না করে আমি ব্যবসাসংক্রান্ত বইপত্র পড়তাম এবং প্রোডাক্ট ডিজাইন অ্যান্ড অর্গানাইজেশনাল ম্যানেজমেন্টের ওপর অনলাইন কোর্স করতাম।’
বিএমএফে তিন বছর কাজ করার পর ২০১৫ সালে টেক্সাসের ‘উইন্ডস্টর্ম ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনে’ নথি-বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি নেন অ্যান্সলি। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অস্টিনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন বিপণন ও প্রশাসন বিভাগে।
চাকরি বদল করাও ছিল অ্যান্সলির জন্য চ্যালেঞ্জ। একেকটা প্রতিষ্ঠান থেকে ‘রিজেকশন লেটার’ পাওয়ার পর তিনি নিজেকেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কি ভুলই করলাম?’
অ্যান্সলি বলেন, ‘একের পর এক চেষ্টায় হেরে যাচ্ছিলাম। কাছের মানুষেরা বলত, কলেজ পাস না করে আমি কখনোই ছয় অঙ্কের বেতন পাব না। কিন্তু আমি এসব “না”-কে কখনো গায়ে মাখিনি। ওসব মন্তব্য আর প্রত্যাখ্যান আমাকে আরও বেশি উজ্জীবিত করত। রোখ চাপত নেতিবাচক মন্তব্যকারীদের ভুল প্রমাণ করা জন্য।’
নেটওয়ার্কিং এবং বর্তমান চাকরিতে যোগদান
অ্যান্সলি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন এভাবে, ‘যখনই কোনো রিজেকশন মেইল পেতাম, তখনই নিজেকে প্রশ্ন করতাম, “আমি কীভাবে নিজেকে আরও ভালো প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারি?” কিংবা “আমার সিভিতে কী কী ঘাটতি আছে?” এ ধরনের প্রশ্ন চাকরিদাতারা ইতিবাচকভাবে নেন। আপনি আত্মোন্নয়নের চেষ্টা করছেন দেখলে তাঁরা খুবই প্রশংসা করেন।’
২০২০ সালে লিংকডইনে মার্কেটিং ছেড়ে প্রোডাক্ট ম্যানেজার হওয়া সম্পর্কে একজনের একটি আর্টিকেল দেখেন অ্যান্সলি। তাঁর ভাষায়, ‘আমি সব সময় টেকনিক্যাল চাকরি করতে চাইতাম। কিন্তু বুঝতাম না কোথা থেকে শুরু করব। ওই আর্টিকেল থেকে যেন আমি ইশারা পেয়ে গেলাম।’
সেই আর্টিকেলের লেখক ক্যামি স্মিথ একদিন অ্যান্সলিকে প্রোটোটাইপিং, ডেটা সংগ্রহ, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রসেস ইত্যাদিসহ আরও কিছু বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে উৎসাহ দেন, যা প্রোডাক্ট ম্যানেজারদের জানা প্রয়োজন। কিছু প্রতিষ্ঠান প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কিংবা সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে স্নাতকদের অগ্রাধিকার দেয়। কিন্তু এসব ডিগ্রি সব সময় আবশ্যক নয়।
সেই থেকে অ্যান্সলি প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে শুরু করলেন। কিছু প্রজেক্টে তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করলেন; প্রোডাক্ট ম্যানেজারদের কাজগুলো খুব ভালোভাবে লক্ষ করলেন; ইউজার টেস্টিং ও বাজার বিশ্লেষণে সহকর্মীদের সাহায্য করতে থাকলেন।
প্রাথমিক আলাপের কয়েক মাস পর ক্যামি স্মিথই তাঁর নিজের কোম্পানিতে অ্যাসোসিয়েট প্রোডাক্ট ম্যানেজার পদে অ্যান্সলিকে চাকরির প্রস্তাব দেন। অ্যান্সলি এখন যেখানে চাকরি করছেন, সেই রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে ২০২১ সালে যোগ দেন ছয় অঙ্কের বেতনে। এটিই প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টে তাঁর প্রথম চাকরি।
ডিগ্রি ছাড়াও প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টে ভালো ক্যারিয়ার গড়া কীভাবে সম্ভব?
২০২৩ সালের অক্টোবরে অ্যান্সলি প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পান। এখন তিনি প্রতিষ্ঠানটির একটি অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যারের দায়িত্বে আছেন। ইঞ্জিনিয়ার ও ডিজাইনারদের সঙ্গে পণ্য তৈরির কাজ করেন। এ ছাড়া ব্যবহারকারীদের মতামত সংগ্রহ এবং সেবাগুলো কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেন।
অ্যান্সলি বাসা থেকে কাজ করলেও ৯টা-৫টা অফিস করেন। অ্যান্সলি বলেন, ‘স্নাতক ডিগ্রি নেই, এমন মানুষদের জন্য প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট হতে পারে বেশ ভালো ক্যারিয়ার। কারণ, এটি প্রকল্প পরিচালনা এবং ডেটা বিশ্লেষণের মতো স্থানান্তরযোগ্য দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ এই একই দক্ষতা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জুতসই। এমনকি আপনার প্রযুক্তিগত পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও অনেক কোম্পানি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। আপনি যদি শিখতে চান, অন্যদের সহযোগিতা করতে চান এবং ধৈর্য থাকে, তবে আপনি এ ধরনের চাকরিতে ভালো করবেন।’
অ্যান্সলির কি মাঝেমধ্যে স্নাতক শেষ করার ইচ্ছা করে না? হ্যাঁ, করে। অ্যান্সলি প্রায়ই ভাবেন, কলেজে ফিরে যাবেন এবং স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করবেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি মনে করি না ওই অধ্যায় পুরোপুরি শেষ। সময় মিললে এবং ডিগ্রি নিলে আমার জীবনে ইতিবাচক কিছু যোগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখলে আমি পড়াশোনা শেষ করব। তবে শেষ পর্যন্ত অনুধাবন করতে পেরেছি যে সফল হতে আমার ডিগ্রির কোনো প্রয়োজন নেই। যত দূর আসতে পেরেছি, তাতেই আমি গর্বিত।’
সূত্র: সিএনবিসি