কোন বয়সের শিশুকে ঘরের কী কাজ করাবেন
একাধিক গবেষণা জানাচ্ছে, শিশুকে ছোটবেলা থেকেই ঘরের কাজে যুক্ত করলে তা ভবিষ্যতে তাকে সফল আর সুখী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। শিশুকে ছোটবেলায় ঘরের কাজ করানোর সঙ্গে পরবর্তী জীবনে সফল আর সুখী হয়ে ওঠার এই সম্পর্ক গভীর ও দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাবশালী। তবে কোন বয়সে কী কাজের সঙ্গে যুক্ত করবেন, তা অভিভাবককে জানতে হবে। ছোট বয়স থেকেই একটু একটু করে কাজের সঙ্গে পরিচিত করাতে হবে। ২ বছরের পর থেকেই শিশুকে ঘরের কজের সঙ্গে পরিচিত করাতে পারেন। যেমন মনে করুন, হাতঘড়িটা শিশুর হাতে দিয়ে বললেন, ‘যাও তো, বাবাকে দিয়ে আসো’, ‘কী খাবে সেটা প্লেটে তুলে নাও’ অথবা ‘কুশনটা সোফার ওপর উঠিয়ে রাখো’ বা ‘খেলনাগুলো সব ঝুড়িতে তুলে রাখো’।
গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্সের চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাকিয়া সুলতানা জানান, ছোটখাটো ঘরের কাজের মধ্য দিয়ে একদিকে শিশু যেমন স্বনির্ভর হয়ে ওঠে, অন্যদিকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাও রপ্ত হয়ে যায়। উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘ধরুন, বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আজ তুমি কী খাবে? বা তিনটি ড্রেস রেখে বলা হলো, কোনটি পরতে চাও? তখন বাচ্চা ভাববে। মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে যুক্তির আলোকে সিদ্ধান্ত জানাবে। বুঝবে যে তার মতামতের একটা গুরুত্ব আছে। আবার ধরুন, আমরা গল্প করি, বাচ্চারা শোনে। একদিন বলা হলো, আজ তুমি একটা গল্প বলো। তখন তার নিজের কল্পনার জগৎ খুলে যাবে। বা বাইরে কী দেখে এলে, বলো। এভাবে সে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে।’
জাকিয়া সুলতানা আরও বলেন, ‘আমি বোধ হয় পারব না’—বাচ্চার মনে এ ভয় আসলে বাবা-মায়েরাই তৈরি করেন। তাঁরা হয়তো কখনো না কখনো বলেছেন, ‘থাক, আমাকে দাও। আমি করে দিচ্ছি। তুমি পারবে না।’ সন্তান পারবে, মা–বাবা কখনো সেই ভরসাই করেননি। অথবা সন্তানকে দিয়ে কখনো কাজটা করানইনি।
কোনো কাজ যদি শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয় অথচ সে করতে আগ্রহ প্রকাশ করে বা জেদ করে, তাহলে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। এ ছাড়া স্কুলের ব্যাগ গোছানো, বই-খাতা গুছিয়ে রাখা, নিজের খাবার খাওয়া, খাওয়ার পর প্লেট ধুয়ে রাখা, টুকিটাকি আনা-নেওয়া, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা—এগুলো তো শিশুরা করতেই পারে।
যা করবেন, করবেন না
শিশুকে সহজ, ছোট ছোট কাজ দিন। কী কাজ, তা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেবেন।
বারবার নিয়ম বদলাবেন না।
কাজটা শেষ করার পর প্রশংসা, হাততালি বা ছোট ছোট উপহার দিয়ে অনুপ্রাণিত করুন।
কাজটা না পারলে ধমক বা বকা দেবেন না। নতুনভাবে শুরু করতে বলুন। কখনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না।
কাজের ভেতর যেন শিশু আনন্দ খুঁজে পায়, সেটা নিশ্চিত করুন।
শিশুরা যা দেখে, তাই-ই করে। আপনি নিজেও শিশুর সঙ্গে কাজে লেগে যান। আপনি হয়ে উঠুন ওর রোল মডেল।
কোন বছরের শিশু কী কাজ করবে
২ থেকে ৩ বছরের শিশু
খেলা শেষে খেলনা গুছিয়ে রাখতে বলুন। ফ্রিজে বা ঝুড়িতে ফল বা সবজি রাখার সময় আপনার শিশুকে বলুন একটা একটা করে আপনার হাতে তুলে দিতে। আর আপনি সেগুলো গুছিয়ে রাখুন। শার্টটা নিজে নিজে পরতে বলুন। আর আপনি বোতাম লাগিয়ে দিন।
৪ থেকে ৫ বছর বয়স
নিজের খেলনা গুছিয়ে রাখার অভ্যাস করান। পোষা প্রাণীকে গোসল করাতে সাহায্য করতে বলুন। নিজের বিছানা, বালিশ যতটুকু সম্ভব গুছিয়ে রাখতে শেখান। ময়লা বা আবর্জনা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে শেখান। নিজে নিজে খাবার খাক। টুকিটাকি জিনিস আনা–নেওয়া করাতে পারেন। ছোট্ট মগ হাতে ধরিয়ে আপনার সঙ্গে গাছে পানি দিতেও বলতে পারেন।
৬ থেকে ৮ বছর বয়স
ময়লা জায়গা ওয়াইপার বা ওয়েট টিস্যু দিয়ে মুছে রাখতে বলুন। মোছার পর ওয়েট টিস্যুটি ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে বলুন। ময়লা জামাকাপড় লন্ড্রি বক্সে রাখতে বলুন। নিজের বিছানা, খেলার জায়গা ইত্যাদি যথাসম্ভব গুছিয়ে রাখতে শেখান। আপনাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াতে বলুন।
৯ থেকে ১০ বছর
বাসনকোসন জায়গামতো উঠিয়ে রাখা, জামাকাপড়, বই–খাতা গুছিয়ে রাখা, খাওয়ার পর নিজের প্লেটটা পরিষ্কার করে রাখা, নিজের খাবার নিজেই টিফিন বক্সে ভরা, নিজের ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি।
১০ বছর ও এর ঊর্ধ্বে
বাজার করতে সাহায্য করা, একটু একটু করে নিজের জামাকাপড় পরিষ্কার করা, সেগুলো ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখা, গাছে পানি দেওয়া, ছোট ছোট রান্না করা, সালাদ কাটা, ডাইনিং টেবিলে খাবারের বাটি আনা-নেওয়া করা, পোষা প্রাণীর যত্ন নেওয়া, বাগানের যত্ন নেওয়া, জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করা ইত্যাদি।
আপনার তো ঘরের কাজ করার লোক আছে, সন্তানকে দেখাশোনা করার জন্য ন্যানি আছে, আপনিও কি শিশুকে দিয়ে কাজ করাবেন?
সে ক্ষেত্রে জেনে রাখুন, শিশুকে ঘরের কাজের সঙ্গে পরিচিত করাবেন আপনার শিশুর বিকাশের জন্য। এর সঙ্গে ঘরে কাজের সহকারী বা ন্যানি থাকা না–থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনার শিশু যখন ঘরের কাজ করবে, তখন সে-ও নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে। এই অংশগ্রহণমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে আপনার সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক, বোঝাপড়া মজবুত হবে। নিজেও একটু একটু করে দায়িত্ব নিতে শিখবে। কাজে আনন্দ খুঁজে পাবে।
দুবাইয়ের দানাত আল ইমারাত হাসপাতালের শিশুবিশেষজ্ঞ ও সাইকোলজিস্ট ডা. হাবিব আবদুল্লাহ বলেন, ‘অভিভাবকেরা অনেক সময় শিশুর বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার সামনে থেকে সব বাধা সরিয়ে দেয়। সব সিদ্ধান্ত নিয়ে দেয়। চলার পথ যতটা সম্ভব মসৃণ করে দেয়। মনে করে, এতেই বোধ হয় শিশুর মঙ্গল। বিশ্বাস করুন, এটা টক্সিক প্যারেন্টিং। আদতে আপনি আপনার শিশুকে ক্রমেই দুর্বল করে গড়ে তুলছেন। শিশুকে তার নিজের সেরা ভার্সন হয়ে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাকে ছোটবেলা থেকেই একটু একটু করে ঘরের কাজে যুক্ত করুন, দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলুন। তাতে শিশুর শৈশব হয়ে উঠবে রঙিন আর আনন্দময়। ভবিষ্যতেও তার জন্য সুখী আর সফল হওয়াও সহজ হবে।’
সূত্র: গলফ নিউজ