শিশুকে যেভাবে ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শের ফারাক শেখাবেন
অনেক মা-বাবা এটা ধারণাই করতে পারেন না, একেবারে কম বয়সী শিশুকেও কেউ খারাপভাবে স্পর্শ করতে পারে। বহুদিনের চেনা এবং আপাতদৃষ্টে বিশ্বস্ত মানুষও শিশুর জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
শৈশবের কোনো দুঃসহ স্মৃতি একজন মানুষকে তাড়া করে ফিরতে পারে জীবনভর। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কোনো ঘটনা শিশুর ব্যক্তিত্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এ ধরনের ঘটনা। একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে আপনার উচিত শিশুকে সব ধরনের পরিস্থিতি সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা দিয়ে রাখা এবং শিশু খারাপ কোনো ঘটনার শিকার হলে তাকে এমনভাবে আগলে রাখা, যাতে কোনোক্রমেই সে হীনম্মন্যতায় না ভোগে।
অনেক মা-বাবা এটা ধারণাই করতে পারেন না, একেবারে কম বয়সী শিশুকেও কেউ খারাপভাবে স্পর্শ করতে পারে। বহুদিনের চেনা এবং আপাতদৃষ্টে বিশ্বস্ত মানুষও শিশুর জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে একজন অভিভাবককে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। কেবল মেয়েশিশুই নয়, ছেলেশিশুও বিকৃত আচরণের শিকার হয়। কারও ক্ষেত্রেই সংবেদনশীল বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এমন পরামর্শই দিলেন বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক সিনিয়র চাইল্ড সাইকোলজিস্ট এবং আন্তর্জাতিক অটিজম প্রশিক্ষক নার্সিস রহমান।
নিজস্বতা গড়ে উঠুক
শিশুর বয়স ২ বছর হতে হতেই সে নিজের দেহের বিভিন্ন অংশের নাম জেনে যায়। এই বয়সেই তাকে শেখাতে হবে, তার শরীরের কোন কোন অংশ তার একান্তই নিজস্ব। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, প্রত্যেকের শরীরেই এমন কিছু নিজস্ব অংশ থাকে, যা চাইলেই যে কেউ দেখতে কিংবা স্পর্শ করতে পারে না। যে কেউ চাইলেই তাকে চুমুও দিতে পারে না। শিশুর বয়সোপযোগী করেই বিষয়গুলো তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
অন্য কারও সামনে শিশুর পোশাক বদলে দেবেন না বা গোসল করাবেন না। পরিবারের কারও উচিত নয় তার সামনে পোশাক বদলানো। কেউ তার সামনে পোশাক খুললে সে যাতে ওই ঘর থেকে সরে আসে, কিংবা ওই ব্যক্তিকেই অন্য ঘরে চলে যেতে বলে, সেটাও শিখিয়ে রাখুন। একটু বড় হলে যখন সে নিজের পোশাক নিজে বদলাতে শিখবে, তখন সে-ও যাতে কারও সামনে পোশাক না বদলায়। বিষয়গুলো বুঝিয়ে বললে সে তার একান্ত নিজস্বতার গুরুত্ব বুঝবে।
ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ
মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদি-নানি—সবাই শিশুকে আদর করেন। বাড়িতে অন্য কেউ বেড়াতে এলেও শিশুকে কাছে ডাকেন, আদর করতে চান। তবে শিশুকে আপনি শিখিয়ে রাখুন, পরিবারের নিকটতম সদস্যের আদর তার যেমন ভালো লাগছে, অন্য কারও আদরে তেমনটা না-ও হতে পারে। যে স্পর্শ শিশুর একান্ত ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করে না, যে স্পর্শে শিশু স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে, সেটাই ভালো স্পর্শ। এর উল্টোটাই হলো খারাপ স্পর্শ।
শিশুর যখন পরিবারের বাইরেও নিজস্ব একটা জগৎ গড়ে উঠতে থাকে, সেই সময়ও কিছু বিষয় শিখিয়ে দিন। বন্ধুর হাত ধরা, শিক্ষকের স্পর্শ, অভিভাবকের উপস্থিতিতে চিকিৎসকের স্পর্শ—এগুলোকে ভালো বা খারাপ স্পর্শের সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। এগুলো হলো ‘ইটস ওকে টাচ’। অর্থাৎ ভালোও নয়, মন্দও নয়। তবে শিক্ষক বা বন্ধুও যদি ‘একান্ত’ অংশে স্পর্শ করতে চায়, সেটিরও প্রতিবাদ করতে হবে। শিশুকে এই সাহসটুকু পরিবার থেকেই দিতে হবে।
শিশুকে যেভাবে সচেতন করে তুলবেন
শিশুকে শিখিয়ে দিন, কারও আদরে অস্বস্তি হলে সে যাতে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে সরে যায়। কেউ যদি জবরদস্তি আদর করতে চায় কিংবা তার শরীরের কোনো ‘একান্ত’ অংশে স্পর্শ করতে উদ্যত হয়, সে যাতে তখনই চিৎকার করে ওঠে। ‘তুমি আমাকে এভাবে ধরতে পারবে না,’ এমন কিছু বলে ওই জায়গা থেকে সরে অন্য কোথাও চলে যায়, যেখানে পরিচিত অনেক মানুষ আছে।
অন্য ব্যক্তিও যদি তাঁর শরীরের কোনো ‘একান্ত’ অংশ দেখাতে চায় বা শিশুকে এসব অংশ স্পর্শ করতে বলে তাহলেও একইভাবে চিৎকার করে সে যেন সরে যায়।
এ ধরনের যেকোনো কিছু ঘটলে সে যেন মা-বাবাকে নির্দ্বিধায় জানায়। এমনকি যদি সেই মানুষটা শিশুর আপন চাচা, মামা, খালা বা ফুপুও হয়ে থাকে।
শিশুকে বুঝিয়ে বলুন, ‘একান্ত’ অংশে এমন স্পর্শ বা স্পর্শের চেষ্টা কখনোই এমন কোনো ‘সিক্রেট’ নয়, যা সে আপনার কাছ থেকে গোপন করবে।
কেউ যদি বলে, ‘দেখি তো, কাপড় খুললে তোমাকে কেমন সুন্দর লাগে?’ কিংবা কাপড় সরিয়ে ছবি তুলতে বলে, তাতেও যাতে সম্মত না হয় সে।
বন্ধুরা যদি এমন কোনো ছবি দেখায়, যাতে অন্য কারও ‘একান্ত’ অংশ দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকেও সে যাতে সরে আসে।
সবারই জানা উচিত
অন্যের শিশুকে আদর করতে অনেকে অতিরিক্ত উৎসাহ দেখান। অধিকাংশ মানুষেরই তেমন খারাপ কোনো উদ্দেশ্যই থাকে না। কিন্তু শিশুটি এমনিতেই এমন আদর, চুমু বা স্পর্শ অপছন্দ করতে পারে। মা-বাবা অনেক সময় শিশুকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কারও কাছে যেতে বলেন। এটা করা যাবে না। যে কারওই উচিত যেকোনো শিশুকে স্পর্শ করার আগে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। এরপর সে স্বস্তিবোধ করলে তখন তিনি তাকে কিছুটা আদর করতে পারেন। তবে সেটিও এমনভাবে করা উচিত, যাতে তার শরীরের ‘একান্ত’ অংশে স্পর্শ না হয়।
শিশু খারাপ স্পর্শের শিকার হলে
শিশু অনেক সময় খারাপ স্পর্শকে বাধা দিতে পারে না। এরপর ভয়ে-লজ্জায় কাউকে বলতেও পারে না, তার সঙ্গে কী ঘটে গেছে। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ভীষণ কষ্ট পায়। কারও কারও মনে অপরাধবোধও জন্মায়। এমনটা হলে মা-বাবা শিশুর মনের খবর জানবেন কী করে? সেটিও জানালেন নার্সিস রহমান।
হঠাৎ করে শিশুর কোনো আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিলে শিশুর কাছে কোমলভাবে জানতে চাইতে হবে, তার কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। যে ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে—
পরীক্ষার ফলাফল হঠাৎ করেই খারাপ হতে পারে।
খাওয়াদাওয়া এবং খেলাধুলায় আগ্রহ হারাতে পারে।
চুপচাপ হয়ে যেতে পারে।
হঠাৎ করেই বিছানায় প্রস্রাব হয়ে যেতে পারে।
কেউ কেউ অনিরাপদ বোধ করতে থাকায় আঙুল চুষতে থাকে।
কেউ আবার অল্পতেই মেজাজ দেখাতে শুরু করে।
কারও কারও চিৎকার বা কান্নার প্রবণতা বেড়ে যায়।
এ ধরনের যেকোনো পরিবর্তন দেখা দিলেই আপনাকে তার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। মা-বাবা ছাড়াও পরিবারে যদি শিশুর খুব প্রিয় কোনো মানুষ থাকেন, যাঁর প্রতি শিশুর ভরসা রয়েছে, তিনিও শিশুর কাছে জানতে চাইতে পারেন তার সমস্যার কথা। প্রয়োজনে শিশু মনোবিদের সহায়তা নিন।
শিশুর কোনো সমস্যা হলে যা করবেন
অবশ্যই তার সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে, রোজ অন্তত আধঘণ্টা। এই সময়টায় শিশুর ভালো লাগার কাজে শিশুর সঙ্গে যোগ দিন। বুঝিয়ে দিন, তার ভালো লাগার কাজটি আপনারও পছন্দ।
ছোট ছোট বিষয়ে তার মতামত নিন। শিশু ডিম পোচ খাবে, নাকি সেদ্ধ খাবে—এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে নিতেও সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে।
ছোট ছোট দায়িত্বও দিন। টেবিল বা বিছানা গোছানোর মতো কাজে তাকে সঙ্গে নিন।
দিনে অন্তত ৮-১০ বার তাকে উৎসাহমূলক কথা বলুন।