ট্রফি হাতে যাঁকে দেখেন, তিনিও কিন্তু একজন মানুষ

পেশাদার টেনিস–দুনিয়ায় ২৩ বছর রাজত্ব করার পর গত বছর নভেম্বরে অবসর নিয়েছেন রাফায়েল নাদাল। ২২ বারের গ্র্যান্ড স্ল‍ামজয়ী এই স্প‍্যানিশ ক্রীড়াবিদের সঙ্গে ‘কিংবদন্তি’ শব্দটা একদম মানানসই। প্লেয়ারস ট্রিবিউনে তিনি তাঁর ভালো-মন্দ সময়ের কথা লিখেছেন।

১২ বছর বয়সে প্রথম ফ্রেঞ্চ ওপেন চ‍্যাম্পিয়ন কার্লোস ময়ার সঙ্গে খেলার সুযোগ পান নাদালছবি: রয়টার্স

ছেলেবেলার একটা শিক্ষা আজও মনে গেঁথে আছে।

বয়স তখন সম্ভবত ১২। মাছ ধরতে খুব ভালোবাসতাম। আর ভালোবাসতাম সাগর। যেহেতু ম্যালোর্কায় বড় হয়েছি, সাগর আসলে জীবনের অংশ ছিল। সাগরপাড়ের বড় বড় পাথরের ওপর পরিবারের সদস‍্য কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে বসে থেকে, নৌকায় ঘুরে বেরিয়ে একটা অদ্ভুত শান্তি লাগত। মনে হতো সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি।

একদিন প্রশিক্ষণ বাদ দিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছি। যা হওয়ার তা-ই হলো, পরদিন ম‍্যাচে হার। মনে আছে, গাড়িতে বাড়ি ফেরার সময় কাঁদছিলাম। পাশেই ছিলেন এক চাচা। আমার ওপর সব সময় তাঁর বেশ প্রভাব ছিল। তাঁর মাধ‍্যমেই টেনিসের প্রতি ভালোবাসা। তিনি বলছিলেন, ‘আরে বোকা, কিচ্ছু হয়নি। এটা তো স্রেফ একটা ম‍্যাচ। এখন কেঁদে লাভ হবে? যদি মাছ ধরতে চাও, ধরো। কোনো সমস‍্যা নেই। কিন্তু যদি জিততে চাও, তাহলে সেটাই তোমার করতে হবে, যা করা উচিত।’ এই শিক্ষাটা আমার জন‍্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজও প্রায়ই কথাটা কানে বাজে।

খেলাধুলার ক্ষেত্রে ছোটবেলায় আমার সামনে কোনো আইডল ছিল না। ম‍্যালোর্কানদের চরিত্রই আসলে এমন। আশপাশে যাঁদের দেখতাম, আমার কাছে তাঁরাই ছিল নায়ক। কিন্তু ১২ বছর বয়সে প্রথম কার্লোস ময়ার সঙ্গে খেলার সুযোগ হয়। তিনিও ম‍্যালোর্কারই বাসিন্দা। ফ্রেঞ্চ ওপেনে সে চ‍্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। প্রথম স্প‍্যানিশ খেলোয়াড় হিসেবে ১ নম্বরে উঠে আসার কৃতিত্বও তাঁর। তাঁর সঙ্গে খেলতে পারাটা একটা অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। আমার জন‍্য তিনি ছিলেন বাইরের পৃথিবীটা দেখার একটা জানালা। তাঁর সঙ্গে খেলার পরই টেনিসটা ‘মজার খেলা’ থেকে জীবিকা বা জীবনের লক্ষ‍্য হয়ে ওঠে। টেনিস নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

আরও পড়ুন
ব‍্যথা আদতে সবচেয়ে বড় শিক্ষক
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু ব‍্যথা আদতে সবচেয়ে বড় শিক্ষক। ১৭ বছর বয়সে এমনই এক ব‍্যথা পেলাম যে বলা হলো আর পেশাদার টেনিস খেলতে পারব না। শুধু যে পায়ের পাতায় সামান‍্য ফাটল ধরেছিল তা নয়, ধরে বসেছিল একটা অসুখ। যে অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই। নিয়ম মেনে চলাই একমাত্র উপায়। অসুখটার নাম মুয়েলার-ওয়েইস সিনড্রোম। ভাবুন তো, কাল সকাল থেকে আপনি আর হাঁটতে পারবেন না, কেমন লাগবে?

দিনের পর দিন বাড়িতে বসে শুধু কেঁদেছি। কিন্তু এটা আমার জন‍্য একটা বড় শিক্ষাও। ভাগ‍্য ভালো, দারুণ একজন বাবা পেয়েছিলাম, যিনি সব সময় ছিলেন ইতিবাচক। বলতেন, ‘আমরা একটা সমাধান খুঁজে বের করব। আর যদি না পারি, তাহলে তো টেনিস খেলা ছাড়াও জীবনে আরও অনেক কিছু করার আছে।’

এই সব কিছুই আমার কানে ঢুকত না। অনেক ব‍্যথা, অস্ত্রোপচার, কান্না, পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার পর আবার খেলায় ফিরি। এর মধ‍্য দিয়েই আমি আদতে লড়াই করা শিখেছি।

টেনিস এমন এক খেলা, যাতে আপনার মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ যাবে। কিন্তু এমন সব আনন্দের মুহূর্তও আসবে, যা আপনি কখনো ভুলতে পারবেন না। বহু জয়ের স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই খেলার নিয়মটাই এমন, নিজের সেরাটা দিয়ে যেতে হয় সব সময়। ঢিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সব সময় নিজেকে উন্নত করতে হবে, এটাই হয়ে ওঠে জীবনের ধ্রুবক। এভাবেই আমি আরও ভালো খেলোয়াড় হয়ে উঠেছি।

আরও পড়ুন
কোর্টে পা ফেলার সময় বুকের ভেতর যে শিহরণ খেলে যায়, এটা বোঝানো খুব কঠিন
ছবি: রয়টার্স
আরও পড়ুন

৩০ বছর ধরে নিজের যে চিত্রটা সারা বিশ্বকে দেখিয়ে এসেছি, ভেতরের অনুভূতিও যে সব সময় একই ছিল, তা কিন্তু না। সত‍্যি বলতে প্রতিটি ম‍্যাচের আগেই নার্ভাস লাগত। ঘুমাতে যাওয়ার সময় মনে হতো, কালকের ম‍্যাচে তো হেরেও যেতে পারি (এমনকি ঘুম থেকে ওঠার পরও মনে হতো!)। টেনিসে এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে আরেক খেলোয়াড়ের পার্থক‍্যটা খুব সূক্ষ্ম। প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে পার্থক‍্য তো আরও কম। কোর্টে অনেক কিছুই হতে পারে। তাই সব ইন্দ্রিয়কে রাখতে হয় সজাগ। কোর্টে পা ফেলার সময় বুকের ভেতর যে শিহরণ খেলে যায়, এটা বোঝানো খুব কঠিন।

পেশাজীবনে আমি সব সময়ই এই আবেগ সামাল দেওয়ার কাজটা ভালো পারতাম। ব‍্যতিক্রম ঘটেছিল শুধু একটা সময়। বছর কয়েক আগের কথা। তখন মানসিকভাবে খুব কঠিন সময়ের মধ‍্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। শরীরের ব‍্যথা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু মাঝেমধ‍্যে কোর্টে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো, নিজের সেরাটা দিতে পারতাম না। এখন বলতে দ্বিধা নেই। কোর্টে ট্রফি হাতে যাঁকে দেখেন, তিনিও কিন্তু একজন মানুষ। ক্লান্ত, শ্রান্ত, আনন্দিত, কৃতজ্ঞ…কিন্তু শুধুই একজন মানুষ।

ভাগ‍্য ভালো আমাকে মানসিক উদ্বেগ মোকাবিলা করতে হয়নি। কিন্তু সব খেলোয়াড়ের জীবনেই এমন সময় আসে, যখন মনকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে খেলাও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এমনও সময় গেছে, যখন ভেবেছি টেনিস থেকে একটা লম্বা বিরতি নিয়ে ফেলব। কিন্তু দিন শেষে এসব বাধা জয় করেই প্রতিদিন সামনে এগিয়েছি, নিজেকে ফিরে পেয়েছি।

টেনিস কিন্তু জীবনেরও শিক্ষক। বেশিরভাগ টুর্নামেন্ট আপনি জিতবেন না। তাতেও কিন্তু ভেতরের মানুষটা একই থাকবে। আনন্দ আর বিষাদ, দুটোই একইভাবে গ্রহণ করা শিখতে হবে। ভালো সময়ে আমি কখনোই নিজেকে সুপারম‍্যান ভাবিনি। খারাপ সময়ে ভাবিনি, আমি মানুষ হিসেবে ব‍্যর্থ। ব‍্যর্থতা, বাধাবিপত্তি, মাথাব‍্যথা, আনন্দ, এসবের প্রক্রিয়ার মধ‍্য দিয়েই তো মানুষ হিসেবে আমরা বেড়ে উঠি।

সবকিছুর পরও দিন শেষে এটা সত‍্য, মানুষ তা-ই পায়, যা সে দেয়।

আমি সব সময় মানুষকে শ্রদ্ধা করে এসেছি। এটাই মা-বাবার শিক্ষা। ছেলেবেলায় বাবা সব সময় বলতেন, ‘উদ্ভাবন করা কঠিন। অনুকরণ করা তার চেয়ে সহজ।’ তিনি কিন্তু টেনিস প্রসঙ্গে এ কথা বলেননি। বলেছেন জীবন প্রসঙ্গে। আশপাশে তাকিয়ে দেখুন, আপনার পছন্দের মানুষ কারা। তাঁরা অন‍্যের সঙ্গে কী ব‍্যবহার করেন, তাঁদের কেন আপনার ভালো লাগে। তাঁদের মতো হতে চেষ্টা করুন, তাহলে হয়তো একটা সুখী জীবন পাবেন। জীবনে যত ম‍্যাচ খেলেছি, এই শিক্ষাটা মনে রেখেছি। প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি আমার কখনো কোনো বিদ্বেষ ছিল না। বরং মন থেকে তাঁদের শ্রদ্ধা করে এসেছি। শুধু চেয়েছি, প্রতিদিন যেই ‘আমি’টা ঘুম থেকে উঠছে, সে যেন আগের দিনের ‘আমি’র চেয়ে একটু উন্নত হয়। তাহলেই তো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারব। সব সময় এই প্রক্রিয়া কাজে লাগেনি, কিন্তু চেষ্টা করে গেছি।

৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই খেলাটাকে নিজের সব উজাড় করে দিয়েছি। বিনিময়ে পেয়েছি আনন্দ আর সুখ। আনন্দ, সুখ, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আরও কত কী…