ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে চায় ড্যাপ, তারপরও কেন বিতর্ক

ড্যাপ হচ্ছে ঢাকা মহানগরের একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মারাত্মক দখল ও দূষণের শিকার ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ।

 ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ২০২২–২০৩৫ সালের জন্য করা মহাপরিকল্পনাটি ২০২২ সালের আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে।

ড্যাপ হচ্ছে ঢাকা মহানগরের একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা। এর মাধ্যমেই ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ভূমি ব্যবহার, আবাসন, পরিবহন, পানিনিষ্কাশন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, সামাজিক ও নাগরিক সেবা নির্ধারিত হবে। সহজ ভাষায় বললে, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কীভাবে হবে, তা এই দলিলের আলোকেই ঠিক হবে।

১৯৫৩ সালের ‘টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট’–এর আওতায় ২০১০ সালে প্রথম ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়। সেটি পাস হওয়ার পর আবাসন ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীদের চাপে এটি চূড়ান্ত করতে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠনে বাধ্য হয় সরকার। ওই কমিটি ড্যাপ চূড়ান্ত না করে উল্টো দুই শতাধিক সংশোধনী আনে। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত জলাভূমি ভরাটের বৈধতা দেওয়া হয়। প্রথম ড্যাপের মেয়াদ ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয়।

নতুন ড্যাপে ৫৪৭ কিলোমিটার জলপথকে ‘নগর জীবনরেখা’ ধরে নতুনভাবে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবান্ধব অবকাঠামো; বিনোদনমূলক স্থান; পরিবেশবান্ধব হাঁটার পথ; জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য ইত্যাদি থাকবে।

প্রতিটি অঞ্চলে একটি করে আঞ্চলিক মাপের পার্কের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ৬২৭টি বিদ্যালয় ও ২৮৭টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রস্তাব করেছে ড্যাপ।

নতুন ড্যাপে নতুন কী

ঢাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বস্তিতে থাকে। ঘিঞ্জি পরিবেশের পাশাপাশি পানি, বিদ্যুৎসহ মৌলিক নানা সেবা নিয়ে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। এই জনগোষ্ঠী যাতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে থাকতে পারে, তার জন্য ড্যাপে সাশ্রয়ী আবাসন নামে স্বতন্ত্র প্রস্তাব করা হয়েছে।

নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের সাশ্রয়ী আবাসনের জন্য ড্যাপে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ৫৮টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থানে এক লাখ ইউনিট ছোট ফ্ল্যাট নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে কয়েক লাখ মানুষের বাসস্থান নিশ্চিত হবে।

নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য সুলভ মূল্যের আবাসনসুবিধা রাখতে ড্যাপে প্রণোদনাও রাখা হয়েছে। কোনো ভবনমালিক তাঁর ভবনে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ছোট আয়তনের (৬০০ বর্গফুটের মধ্যে) পাঁচটি ফ্ল্যাট নির্মাণ করলে প্রণোদনা পাবেন। প্রণোদনা হিসেবে ওই ভবন নির্মাণে স্বাভাবিকের চেয়ে এফএআরের (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) মান শূন্য দশমিক ৭৫ বেশি দেওয়া হবে।

জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ–সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে খসড়া পরিকল্পনায় ভবনের উচ্চতা বেঁধে দিয়েছে ড্যাপ
ছবি: মো. আল-আমিন মাসুদ

পার্ক ও খেলার মাঠের সংকট কাটাতে ড্যাপে ব্লকভিত্তিক আবাসনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান রেখে অপেক্ষাকৃত ছোট প্লটগুলো একত্র করে ব্লক আকারে ভবন নির্মাণ। এতে তুলনামূলকভাবে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যাবে। কমিউনিটিভিত্তিক ছোট পার্ক ও খেলার মাঠ নির্মাণের সুযোগ তৈরি হবে।

ড্যাপে গণপরিবহনব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনার আওতায় ঢাকার সঙ্গে আশপাশের শহরগুলোকে যুক্ত ও যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে ছয়টি মেট্রো, দুটি বিআরটি, ছয়টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের সমান্তরালে দুটি প্রধান সড়ক, দুটি রিং রোড (বৃত্তাকার সড়ক), রিং রোডের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার জন্য রেডিয়াল রোড এবং বৃত্তাকার নৌপথের প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকার চারদিকে মোট ১৩টি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল এবং ২টি ট্রাক টার্মিনালের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ড্যাপ নিয়ে তর্কবিতর্ক

জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ–সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে  খসড়া পরিকল্পনায় ভবনের উচ্চতা বেঁধে দিয়েছে ড্যাপ। বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে স্থপতি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা এর তীব্র সমালোচনা করেন।

পরে সেই ব্যবস্থা থেকে সরে ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআর ভিত্তিতে ভবনের আয়তন নির্ধারণের সুপারিশ করে রাজউক। এতে করে আবার ধানমন্ডি, গুলশানের মতো পরিকল্পিত এলাকার তুলনায় অন্যান্য এলাকার ভবনের আয়তন কমে যায়। আবারও সমালোচনা হলে গত বছর কিছু সংশোধন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে রাজউক। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

ড্যাপ সংশোধনের দাবি করে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব নেতারা বলেছেন, ড্যাপে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকার জন্য পৃথকভাবে ভবন নির্মাণের যে এফএআর নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি বৈষম্যমূলক। নির্দিষ্ট কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় এমনটি করা হয়েছে। এ কারণে বেশির ভাগ এলাকায় আগে ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, তার তুলনায় এখন ৬০ শতাংশ পাওয়া যাবে। এতে জমির মালিক, ফ্ল্যাটের ক্রেতা–বিক্রেতা—সবাই ক্ষতির মুখে পড়বেন। শুধু তা–ই নয়, আশপাশের খাল-বিল, জলাশয় ও কৃষিজমি দ্রুত হ্রাস পাবে।

ড্যাপে গণপরিবহনব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে
ফাইল ছবি

ড্যাপ সংশোধনের দাবি জানান বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের নেতারাও। তাঁরা বলেছেন, ড্যাপে বিদ্যমান বৈষম্য ও ক্ষেত্রবিশেষে অস্পষ্টতার কারণে নতুন ভবনের নকশার অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলার সময় রাজউকের অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে সময়ক্ষেপণ, বিভ্রান্তি ও দুর্নীতি, সর্বোপরি জমির মালিক তথা জনসাধারণের অযাচিত হয়রানি।

জানা যায়, নতুন ড্যাপে মিরপুর–১০ ও ১১, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, আগারগাঁও, বাড্ডা, কুড়িল, খিলক্ষেত, নিকেতন, নয়াটোলা, মধুবাগ, গোড়ান, সিপাহীবাগ, মধ্য বাসাবো, আনসারাবাদ, সবুজবাগ, কদমতলা, দক্ষিণগাঁও, মালিবাগ, শান্তিবাগ, শুক্রাবাদ, পশ্চিম রাজাবাজার, জিগাতলার মতো এলাকায় এফএআর কম দেওয়া হয়েছে। অবশ্য কোনো জমি প্লট আকারে ভাগ না করে একসঙ্গে ‘ব্লক’ করে ভবন তৈরি করলে নির্মাণে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। 

অন্যদিকে গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডির মতো এলাকায় এফএআর বেশি। সাধারণত যেসব এলাকায় যত বেশি এফএআর, সেখানে ভবনের আয়তন তত বেশি হবে। আয়তনের সঙ্গে ভবনের উচ্চতা কিংবা ফ্ল্যাটের সংখ্যার বিষয়টিও জড়িত।

রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে দুই ধরনের অনুমোদন নিতে হয়। প্রথমত, ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র। দ্বিতীয়ত, নির্মাণ অনুমোদন। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হয় ড্যাপ অনুসরণ করে। অন্যদিকে নির্মাণ অনুমোদন দেওয়া হয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে। নতুন ড্যাপের আলোকে ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা করার প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) প্রস্তাবিত বিধিমালা সংশোধনের একগুচ্ছ প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে রাজউকে দিয়েছে। এতে প্লট–সংলগ্ন রাস্তার প্রশস্ততাসংশ্লিষ্ট অনুমোদনযোগ্য এফএআর সূচক এবং এলাকাভিত্তিক এফএআর বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে (ওয়ার্ড ৩১) ২০ ফুট সড়কের পাশের প্লটের এফএআর ২ দশমিক ৭৫। আর এলাকাভিত্তিক এফএআর ২ দশমিক ৩। সেখানকার কাঠাপ্রতি জনঘনত্ব ১ দশমিক ৯। ফলে ৫ কাঠা জমিতে সর্বোচ্চ ৮ হাজার ২৮০ বর্গফুট আয়তনের ভবন করা যাবে। ফ্ল্যাট করা যাবে ৯–১০টি।

প্রস্তাবিত ইমারত বিধিমালায় রিহ্যাব যে প্রস্তাব করেছে, সেটি বাস্তবায়িত হলে মোহাম্মদপুরের ওই ওয়ার্ডে ২০ ফুট সড়কের পাশের প্লটের এফএআর হবে ৪ দশমিক ২৫। আর এলাকাভিত্তিক এফএআর ৪ দশমিক শূন্য ৪। সেখানকার কাঠাপ্রতি জনঘনত্ব ২ দশমিক ৮৯। ফলে ৫ কাঠা জমিতে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৫৪৪ বর্গফুট আয়তনের ভবন নির্মাণ করা যাবে। তখন ফ্ল্যাট হবে ১৪–১৫টি।

ভবনের আয়তন বাড়ানো হলে ঢাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা যাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধার দোহাই দিয়ে অনেক এলাকার ভবনের আয়তন কমিয়ে দেওয়াটা অযৌক্তিক। কারণ, এতে করে ঢাকার আশপাশের খাল–বিল ও জলাশয় ভরাটের প্রবণতা বাড়বে। তাতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের কেউ কেউ অবশ্য ভিন্নমত। তাঁরা বলছেন, যে এলাকার রাস্তা সংকীর্ণ, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো নয়, খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত অঞ্চল নেই, কাছেপিঠে স্কুল বা হাসপাতাল নেই, সে জায়গায় যদি সুউচ্চ ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আরও বেশি মানুষ সেখানে বাস করবে। বিদ্যমান যে অবকাঠামো, তার ওপর আরও বেশি চাপ পড়বে। আবার ভবনের উচ্চতার সঙ্গে ফ্ল্যাটের দামের সম্পর্ক খুবই সামান্য। ২০০৮ সালের আগে ধানমন্ডি, গুলশান, মিরপুরে ছয়তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যেত। ২০০৮ সালের বিধিমালাটি কার্যকরের পর একই জমিতে ১২ থেকে ১৫ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু ফ্ল্যাটের দাম কমেনি; বরং বেড়েছে।