ঘরের সাজসজ্জায় এখন যা চলছে
কারও বাড়িতে ঢুকে গৃহকর্তার সঙ্গে কোনো কথা না বলেও কিন্তু মানুষটাকে ঠিক ঠিক চিনে নেওয়া যায়। কীভাবে? অন্দরমহল দেখে। মানুষ যেখানে থাকে, তার চারপাশে মানুষটির অভ্যাস, পছন্দ–অপছন্দরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে। তাই গৃহসজ্জাটা খুব জরুরি। গৃহসাজে কোন ধারাগুলো এখন ট্রেন্ডি, জানাচ্ছেন অন্দরসজ্জাবিদ সাবিহা কুমু
আগে মানুষ ব্যক্তিগত সাজসজ্জায় যতটা মনোযোগী ছিল, গৃহসজ্জায় তার সিকিভাগও ছিল না। ভাবখানা এমন, গৃহসজ্জা নিয়ে অত ভাবার কী আছে, ও একটা হলেই হলো। সময় বদলেছে, কমবেশি সবাই এখন গৃহসজ্জার দিকে মনোযোগী হচ্ছে। ব্যক্তিগত রুচির সঙ্গে সাধ্যের সমন্বয় করে সাজিয়ে–গুছিয়ে নিচ্ছে আপন গৃহকোণ।
আর তাই দেখা যায়, একই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের একই আকারের দুটো ফ্ল্যাট শুধু সাজসজ্জার গুণে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়েছে। কারণ আর কিছুই নয়, গৃহকর্তার নিজস্ব রুচি। কেউ অন্দর নকশা করছে আধুনিক কেতায়, কারও নকশায় প্রাধান্য পাচ্ছে ঐতিহ্য, কারও আবার পছন্দ দুইয়ের মিশেল।
অন্দরসজ্জায় এখন কী ধারা
বাংলাদেশে গৃহসাজে ট্রেন্ডের কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয়—আধুনিক, ভিক্টোরীয়, সমকালীন ও ঐতিহ্যবাহী—এই চার স্টাইলই মূলত অনুসরণ করা হচ্ছে। আধুনিক আর ঐতিহ্যের মিশেলও দেখা যাচ্ছে। তবে ঐতিহ্যবাহী ও সমসাময়িক ধরনটাই চলছে বেশি; কারণ, উপকরণের সহজলভ্যতা।
আধুনিক ধারা
এই ধারায় শুধু অন্দরের সাজসজ্জা নয়, পুরো ফ্ল্যাটের অবয়বকেই মনের মতো নকশা করে নেওয়া হচ্ছে। আসবাব, ফার্নিশিং, ঘর সাজানোর নানা পিস, বাগান, সাজসজ্জাসামগ্রী—সব ক্ষেত্রেই বেছে নেওয়া হচ্ছে আধুনিক সব উপকরণ। কাঠ, বোর্ড, ধাতু, বিভিন্ন ধরনের টাইলস, নকশা আঁকা কাচ, ভারী র অথবা সিল্কি কাপড়, বিভিন্ন ধরনের লাইট ফিক্সার, চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র, পোর্ট্রেট ইত্যাদির সমন্বয়ে করা হয় অন্দরসজ্জার ডিজাইন ও ডেকোরেশন। দেয়ালগুলো বিভিন্ন রঙে রাঙানো হয়, যেখানে নানা টেক্সচার, বিভিন্ন রাস্টিক স্টোনের ব্যবহার হয়ে থাকে। সিলিং, দেয়াল ট্রিটমেন্ট, মেঝে ট্রিটমেন্ট, আসবাব, আলোক সরবরাহ—সবকিছুকেই কম্পোজিশনের আওতায় এনে দাঁড় করানো হয় নকশা। দেয়ালের সঙ্গে আসবাব ও ফার্নিশিংয়ের রঙের সমন্বয় করে পুরো ফ্ল্যাটের ডিজাইন করা হয়।
আধুনিক ধারার গৃহসাজে ইনডোর প্ল্যান্ট ও ঝরনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সে জন্য অধিকাংশ ফ্ল্যাটেই বারান্দাটিকে ছোটখাটো একটা বাগানে রূপ দেওয়া হয়। ছোট করে বসার আয়োজনও থাকে। ভোরের একচিলতে আলো মেখে যেখানে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলানো যায় কিংবা বিকেলের নরম আলোয় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে হারিয়ে যাওয়া যায়।
ভিক্টোরীয় ধারা
অপেক্ষাকৃত বিত্তশালীদের কেউ কেউ আবার ভিক্টোরীয় রীতি পছন্দ করে। তাদের কাছে ভিক্টোরীয় অন্দর আভিজাত্যের প্রতীক। এ ধরনের অন্দরসজ্জায় ভারী অলংকরণের আসবাব, অলংকরণবহুল ঝাড়বাতি, লেইস ব্রোকেড, মসলিনের পর্দা, বড় আকৃতির দেয়ালঘড়ি, চিত্রকর্ম, নকশা করা ছাদ, বর্ণিল কার্পেট ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয় পুরো বাড়ি।
তবে ঘরের আকৃতি ও আবহাওয়ার ধরনের কারণে বাংলাদেশে ভিক্টোরীয় রীতিটা খুব ভালো মানায় না। তাই আমরা অন্দরসজ্জাবিদেরা এই রীতিতে ঘর সাজানোটাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করি। তবে কারও যদি বড় ও খোলামেলা বাসা থাকে, সে ক্ষেত্রে এমন সাজসজ্জা করা যেতে পারে।
সমকালীন ধারা
সমকালীন ধারায় বাড়ির অন্দরসাজের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক নিয়ম মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ, যেমন রঙের ব্যবহার, লাইন ও স্পেস নির্বাচন, আসবাব ও মেঝের নকশা, আঁকা ছবি, লাইটের ব্যবহার, ফুল ও গাছপালার উপস্থিতি ইত্যাদি।
সমকালীন রীতির গৃহসাজে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে, সেগুলোর মধ্যে আছে সাদামাটা নকশার কাঠ বা বোর্ডের আসবাব, স্বাভাবিক রং, কুশন, কার্পেট বা রাগসে জ্যামিতিক নকশার প্রাধান্য, বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য, আঁকা ছবিতে অবয়বের উপস্থিতি, মেঝেতে কাঠ এবং রাস্টিক টাইলসের ব্যবহার। নির্মাণসামগ্রীর উপাদানগুলোকে র রেখেই ব্যবহার করা হয়। যেমন বিভিন্ন এসি লাইটিং ডাক্ট, পাইপ, তারগুলোকে ঢেকে না দিয়ে দৃশ্যমান রেখে দেওয়া হয়। চাইলে এসব জিনিস কাপড় বা রং দিয়ে মুড়িয়ে নেওয়া যায়। আবার ইটের গাঁথুনির দেয়ালটিকে পলেস্তারায় না ঢেকে নগ্ন রেখে দেওয়া যায়। ফ্ল্যাটের পাশাপাশি বিভিন্ন শোরুমও এখন সমকালীন রীতিতে নকশা করা হচ্ছে।
সমকালীন ধারার অন্দরসজ্জায় দরজা, জানালার কাপড়ে মোটা জুট, কটন, খাদি, উলেন, জামদানি কাপড়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রচুর সতেজ গাছ, মোম, পাথরের ব্যবহার হচ্ছে।
ঐতিহ্যবাহী ধারা
এ ধারার অন্দরসজ্জায় স্থানীয়, ঐতিহ্যবাহী ও অ্যান্টিক উপাদানগুলোর ব্যবহার হয় বেশি। আমাদের দেশে যেমন বাঁশ-বেতের আসবাব, শতরঞ্জি, মাদুর, শীতলপাটি, মাটির পাত্র, পুরোনো সিরামিকের পাত্র বা ফুলদানি, কাঁসা-পিতলের তৈজস, তাঁত, জামদানি, ব্লকপ্রিন্ট বা কাঁথা কাজের পর্দা, নকশিকাঁথার বিছানার চাদর, কাঠের নকশাদার আয়না ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া হয় ঘর।
অনেকের বাড়িতেই পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত কিছু না কিছু অ্যান্টিক সামগ্রী থাকে। যেমন লোহার ট্রাংক, পিতলের কলসি, পিতলের পানের বাটা, জলচৌকি, সুপারি কাটার সুরতা, কাচের বয়াম, নানি-দাদির ব্যবহৃত গরদ কাতান বা জামদানি শাড়ি, পুরোনো কাঠের আসবাব। এসব নানাভাবে গৃহসাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন নানি-দাদির কাছ থেকে পাওয়া বহু ব্যবহারে ফেঁসে যাওয়া শাড়িখানা কেটে পর্দার পেলমেট করা যেতে পারে। পুরোনো লোহার ট্রাংকটির ওপর একটা পুরু কাচ বসিয়ে সেন্টার টেবিল বানিয়ে নেওয়া যায়। ট্রাংকের টেবিলটির ওপর পিতলের পানের বাটাটা যদি সাজিয়ে রাখেন, তাহলে পুরো জায়গাটা দেখতে অভিজাত মনে হবে। পুরোনো কাতান শাড়ি কেটে রানার বানিয়ে ডাইনিং টেবিলে বিছানো যেতে পারে। পুরোনো সিরামিকের পাত্রগুলো সাধারণত পেইন্টেড থাকত, এমন একটি সিরামিকের পাত্র টেবিলের ওপর রেখে পানি ঢেলে ভাসমান মোম জ্বালিয়ে কিছু ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিলে জায়গাটি মোহনীয় হয়ে উঠবে।
এভাবে পুরোনো জিনিসগুলোকে নতুনভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে পারিবারিক ঐতিহ্য তুলে ধরা সম্ভব। হয়তো আপনার সংগ্রহে আছে নানার হাতের লাঠি বা দাদার বসার হাতলওয়ালা সাদামাটা একখানা চেয়ার। চেয়ারটিও ঠাঁই পেতে পারে আপনার বসার ঘরে। আরও ভালো হয়, এই চেয়ারের এক কোণে যদি এটার ছোট্ট ইতিহাস লিখে রাখা যায়। অতিথি এলে জনে জনে বলে দিতে হবে না এই চেয়ারের মাহাত্ম্য।
অনেকে আবার আধুনিকের সঙ্গে ঐতিহ্যের মিশেলে ঘরদোর সাজিয়ে থাকেন, সেখানেও এসব জিনিস দারুণ প্রাসঙ্গিক।
যে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে
বাংলাদেশের অন্দরসজ্জায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়, তার মধ্যে প্রথমেই আসে ঋতু। ঋতুবৈচিত্র্যের এই দেশে বিভিন্ন ঋতুর প্রভাব যেমন মানুষের মনে, তেমনি অন্দরেও পড়ে। তাই ঋতুভেদে ঘরের সাজসজ্জায় আনা প্রয়োজন হয়ে পড়ে ভিন্নতা। বিশেষ করে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত—এই তিন ঋতুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাই এই তিন ঋতুতে ঘরের সাজসজ্জাতেও আসে ভিন্নতা। বিশেষ করে ফার্নিশিং পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে সবচেয়ে বেশি। যেমন পর্দা, সোফা, কুশন কাভার, বিছানার চাদর, কার্পেট ও রাগস। তাই ঋতু অনুযায়ী এগুলোর রং ও নকশায় পরিবর্তন আনা জরুরি।
যেমন শীতকালে পর্দা নির্বাচনে প্রাধান্য পায় কিছুটা ভারী ও গাঢ় রং। ঘন বুননের ভারী কাপড় তাপ কুপরিবাহী। তাই শীতকালে ভারী পর্দা ঝোলালে বাইরের ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকতে বাধা পাবে। যে কারণে ঘর অনেকটাই উষ্ণ বোধ হবে। এ সময়ে ওয়ার্ম লাইট, অর্থাৎ হলদেটে লাইটের ব্যবহারেও ঘর উষ্ণ মনে হবে। মেঝেটাও চাইলে কার্পেটে মুড়িয়ে নেওয়া যায়।
তেমনি গ্রীষ্মকালে অপেক্ষাকৃত পাতলা কাপড়, ধরুন সুতি, তাঁত বা জুট কাপড়ের পর্দা ব্যবহারে ঘরটা মনে হবে শীতল। এ ধরনের কাপড় তাপ সুপরিবাহী বলে বাইরের আলো-বাতাস সহজেই ঘরে প্রবেশ করতে পারবে, ঘর হবে শীতল। এই সময়ে ঘরে হলুদ লাইটের পরিবর্তে সাদা লাইট বেশি ব্যবহার করতে হবে। পুরো মেঝে কার্পেটে না মুড়িয়ে ছোট ছোট রাগস বিছাতে হবে।
আবার বর্ষাকালে আবহাওয়া থাকে স্যাঁতসেঁতে, তাই এই সময় সুতি বা সিল্কের কাপড় নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এই সময় সিনথেটিকের পর্দা লাগালে ভালো। মেঝেতে কার্পেট বা রাগস না বিছানোই ভালো। এতে ঘর স্যাঁতসেঁতে হতে পারে।
গৃহসজ্জায় আরেকটি জরুরি বিষয় হলো বাগান। মোটামুটি সব ধরনের অন্দরসাজেই ঘরের নানান জায়গায় ও বারান্দায় প্রচুর সবুজ সতেজ গাছ থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইনডোর প্ল্যান্টগুলো বেছে নিতে পারেন। গাছের সঙ্গে মোম, পাথর, পানিজাতীয় প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর সমন্বয় করতে হবে।
বাগানের ব্যাপারে আজকাল অনেকেই মনোযোগী হচ্ছেন। প্রত্যেকেই নিজ বাসার ব্যালকনিতে সাধ্যমতো বাগান করেন। সেই সুবিধাটুকু যদি না থাকে, তাহলে ঘরের মধ্যেই এখানে-সেখানে বিভিন্ন ইনডোর প্ল্যান্ট রাখা যায়। এই নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় ইট-কাঠ-কংক্রিটের জঞ্জালে প্রাণটা যখন হাঁসফাঁস করে, তখন এই একচিলতে বারান্দা বাগানটিই হয়ে উঠতে পারে প্রশান্তির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
ঘরের সঙ্গে বাসিন্দাদের একটা আত্মিক যোগাযোগ থাকে, যে টানে দিন শেষে নীড়ে ফেরে সবাই। একটা মনের মতো অন্দর সেই ঘরের বাসিন্দাদের রাখতে পারে প্রাণবন্ত। নিজের পছন্দ–অপছন্দ বিনা বাক্য ব্যয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে তার অন্দর। তাই রুচির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অন্দরে আনুন প্রশান্তি। যেখানেই থাকেন না কেন, তখন ঘরেই পড়ে থাকবে আপনার মন।