আলোয় অনন্য অন্দর
যত আধুনিক সাজসজ্জাই বাড়িতে থাকুক না কেন, আলো থাকা জরুরি। অন্দরের আলোক সরবরাহ করতে হয় পরিকল্পনা করে। ঘরের একেক স্থানে একেক ধরনের আলোর প্রয়োজন। কোথায় কেমন আলো ব্যবহার করবেন, সে বিষয়েই লিখেছেন স্থপতি সাইফুর রহমান
যে জায়গাটুকুতে আপনি সব সামাজিকতা, বাহ্যিক আর আনুষ্ঠানিকতার জাল ছিঁড়ে সবচেয়ে বেশি আপন হয়ে উঠতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, সেটিই ঘর। আর সেই ঘরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে আলো। ঘরের আলোকব্যবস্থা যে কেবল ঘরের কাজের জন্য জরুরি, তা–ই নয়; বরং অন্দরের সৌন্দর্য, আপনার মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা—এসবেরও দেখভাল করে। শরীর ও মন ছাপিয়ে আপনার ভাবনায়ও প্রভাব ফেলে অন্দরের আলোকসজ্জা।
আলো আর অন্ধকারের সহাবস্থান একটা স্থানের ত্রিমাত্রিক ধারণা দেয়। আমরা দেয়াল আর দরজা–জানালার মাধ্যমে একটা বিস্তৃর্ণ খোলা জায়গা থেকে ওই ত্রিমাত্রিক স্থানকে সংজ্ঞায়িত করি। তাই স্থাপত্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ হলো আলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা। আমার মতে, প্রাথমিকভাবে প্রতিটি কক্ষ এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে, যেন সর্বোচ্চ প্রাকৃতিক আলো-বাতাস নিশ্চিত করা যায়। বেডরুমে তুলনামূলকভাবে আলো কম ঢুকলেও অসুবিধা নেই। আর প্রাইভেসির কারণে টয়লেটে জানালা দেওয়া হয় না, কেবল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকে। তবে ন্যূনতম যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু নিশ্চিত করতে হবে। আলোর উৎসের অবস্থান ও বিন্যাস এমন হওয়া উচিত, যেন আলোর অপচয় বা দূষণ না হয়। আলোর রং নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজেদের জন্য উপযুক্ত আলো নির্বাচন করতে হবে। আলোর রং নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটা মাথায় রাখা ভালো যে একেক রং মানুষের মস্তিষ্কে একেক অনুভূতি দেয়।
স্থপতি অনিন্দ্য গৌরবের মতে, সাধারণত ঘরের সবচেয়ে বড় অংশটা রাখা হয় দক্ষিণমুখী করে। আর সেখানে থাকে টানা বারান্দা বা টেরেস। যাতে করে ঘরে সবচেয়ে বেশি আলো আর বাতাস ঢুকতে পারে। কিন্তু দক্ষিণমুখ যথাসম্ভব খোলা রাখায় বাতাস বয়ে নিয়ে আসে বৃষ্টিও। তাই বারান্দা রাখা হয়, যাতে সরাসরি তাপ বা বৃষ্টি ঘরে না ঢোকে। বাসার যেদিকে জানালা–দরজা কম, সেই দিকটি সাধারণত পশ্চিম। কেননা সেদিক দিয়েই সবচেয়ে বেশি তাপ ঢোকে। এই স্থপতি বলেন, ‘প্রাকৃতিক আলোর একমাত্র উৎস সূর্য। আমরা আলোতে থাকি। কিন্তু সাধারণত সূর্যের দিকে তাকাই না। অর্থাৎ আলোর উৎস চোখে পড়া আমাদের স্বভাবে নেই। অথচ ঘরের আলোর উৎস আমাদের চোখে লাগে। এটা স্বাভাবিকতার বাইরে। তাই আমরা এখন যতটা সম্ভব সিলিংয়ে আলোর উৎসটা রাখি বা চট করে চোখে পড়ে না, আলোটা এমন জায়গায় রাখি।’
আরেক স্থপতি আছিয়া খাতুনও সহমত। সঙ্গে যোগ করেন, কেবল পড়ার ঘর ছাড়া আর কোথাও উজ্জ্বল বা হলুদ আলোর দরকার নেই। অন্য সবখানে নরম সাদা আলোই যথেষ্ট। তবে কেমন আলো ব্যবহার করবেন, তা ওই ঘরের দেয়ালের রং, কারুকাজ, কী কী আসবাব আছে—এ রকম নানা কিছুর ওপর নির্ভর করে। এই যেমন জাপানিরা মাইল্ড বা মেলো আলো ব্যবহার করে। আর ওদের দেয়ালে থাকে সোনালি, রুপালিরঙা কারুকাজ। ওই কাজগুলো স্পষ্ট আলোয় ভালো লাগবে না। কিন্তু অল্প আলোয় সেগুলো চকচক করে, মনে হয় সোনা। রহস্য তৈরির জন্য অন্ধকার প্রয়োজন। তাই যে ঘর আপনি একটু রহস্যময় রাখতে চান, সেখানে অল্প পরোক্ষ আলো ব্যবহার করুন।
শোবার ঘরের আলো
ধরুন, আপনার শোবার ঘরটাই পড়ার ঘর। শোবার ঘরের এক পাশে চেয়ার–টেবিল, আরেক পাশে ড্রেসিং টেবিল। যেহেতু একই জায়গা একাধিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাই সেখানে বিভিন্ন রকম আলোর সংমিশ্রণ থাকতে পারে। যেমন টেবিলে টেবিল ল্যাম্প রাখতে পারেন। ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে বই পড়ার অভ্যাস থাকলে একটা ঝুলন্ত বাতি ব্যবহার করা যায়, যেটা মূলত বইয়ের ওপর পড়বে। অনেকে ফ্লোরস্ট্যান্ড ল্যাম্পও ব্যবহার করেন।
এ ছাড়া এমনিতে শোবার ঘরে একটু নরম আলো ব্যবহার করা উচিত। সে ক্ষেত্রে সিলিংয়ে সারফেস লাইট, কনসিল লাইট, ফলস সিলিংয়ে পকেট লাইট দিতে পারেন, যা পরোক্ষভাবে ঘরকে আলোকিত করে। আবার ডিমার কনট্রোল লাইটিংও করা যেতে পারে। বেডরুমের একটা পাশই হতে পারে আপনার ওয়ার্কস্টেশন। কাজের সময় আপনি হয়তো ঔজ্জল্য বাড়িয়ে নিলেন। অন্য সময় কমিয়ে রাখলেন। শোবার ঘর যদি ড্রেসিং ইউনিট থাকে, সে ক্ষেত্রে আলোকব্যবস্থা এমনভাবে হবে, যাতে আলো সরাসরি মুখ ও শরীরে এসে পড়ে। আধুনিক ড্রেসিং টেবিল বা ভ্যানিটিতে আলোর ব্যবস্থা থাকে। সেই আলো স্বাভাবিক সাদা আলো। কেননা সাজসজ্জার ক্ষেত্রে আপনি দিনের আলোর মতো নিজেকে স্বাভাবিক আলোতেই দেখতে চাইবেন। অনেকে আবার রাতে ঘুমানোর সময় ডিমলাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেটি হালকা হলুদরঙা হতে পারে, যা আমাদের মস্তিষ্ককে শান্ত ও রিল্যাক্সড রাখতে সাহায্য করে।
স্থপতি অনিন্দ্য গৌরব মনে করেন, শোবার ঘরে আলোকে ঘরে ডেকে আনে, এমন বড় জানালা বা আলোর উৎস না থাকাই ভালো। অনেকে সে রকমটি করে পরে আলো ঠেকানোর জন্য আবার ভারী পর্দা ব্যবহার করেন। তার চেয়ে ছোট একটা বা দুটো জানালা থাকতে পারে। এতে ঘুম ভালো হবে। ভোরে সূর্য উঠতেই হুড়মুড় করে আলো ঢুকে ঘুমের বারোটা বাজাবে না। শোবার ঘরকে অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করে কেবল ঘুমানোর কাজে ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো।
বসার ঘরের আবহ
লিভিং বা ড্রয়িংরুমে এখন আধুনিক নানা আলোকসজ্জার দেখা মেলে। ড্রয়িংরুমের দেয়ালে অনেক সময় পেইন্টিং বা পারিবারিক ছবি থাকে। সেই ছবির ওপর ফোকাস করতে রাখা হয় বিশেষ আলোর ব্যবস্থা। আবার ড্রয়িংরুমে অনেকেই একটা ঝাড়বাতি বা শ্যান্ডেলিয়ার ঝুলিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। বাজারে এখন আধুনিক, কনটেমপোরারি, রাস্টিক—নানা ধাঁচের ঝাড়বাতি পাওয়া যায়। ঘরের জায়গা কমে আসায় ঝাড়বাতির চল কমে এলেও আভিজাত্য প্রকাশে ঝাড়বাতির বিকল্প পাওয়া ভার। এ ছাড়া ড্রয়িংরুমে আলো–আঁধারি একটা রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে, সেটাকে আরও আড্ডামুখর করে তোলা যেতে পারে। এ জন্য ঘরের কোণে কম ওয়াটের নানা ফ্যান্সি ঝুলন্ত আলোও টাঙিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
রান্নাঘরের আলো এমন হবে, যাতে কাটাকুটি করতে সুবিধা হয়। শিশুর ঘরেও নরম আলোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আলোর উৎসগুলোকে বানিয়ে ফেলতে পারেন নানা কার্টুনের চরিত্র, ফল, সবজি বা ছাতা।
ডাইনিংয়ের আলোকসজ্জা
ডাইনিংরুমকে নিছক ডাইনিংরুম ভেবে ভুল করবেন না। মনে রাখবেন, নগরজীবনের কর্মব্যস্ত দিন শেষে ঘরে ফিরে এখানেই প্রতি রাতে পরিবারের সব সদস্য একত্র হন। সারা দিনের টুকরোটাকরা গল্প ডাইনিং টেবিলেই ছড়িয়ে পড়ে। কখনোবা রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে পায়েস বা কফির মগ নিয়ে ডাইনিংয়েই জমে ওঠে আড্ডা। শুধু কী তাই, অফিসের কলিগদের নিয়ে রাতভর ডিনার পার্টিও চলে ডাইনিংকে কেন্দ্র করে।
ডাইনিংরুমে খুব বেশি আসবাব না রাখার পরামর্শ দেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য বিভাগের প্রভাষক তাহমিনা রহমান, ‘ডাইনিংরুমে মূলত ডাইনিং টেবিল আর চেয়ারটাই মুখ্য। সেই সঙ্গে খাবারের প্রয়োজনীয় বাসনকোসন রাখার জন্য একটা র৵াক থাকতে পারে। এই ঘরে যাতে সবাই ঠিকভাবে চলাফেরা করতে পারে, সে জন্য জায়গা রাখতে হবে। দিনের আলো যাতে ঢুকতে পারে, সে ব্যবস্থা থাকাও খুবই জরুরি। আলোটা ডাইনিং টেবিলকে কেন্দ্র করে হতে হবে, যেন টেবিলটা আলোকিত থাকে। অন্য কোথাও অতটা আলো না হলেও চলবে।’
চাইলে ডাইনিংয়েই মাঝেমধ্যে সেরে ফেলতে পারেন ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। সে ক্ষেত্রে সবার আগে টেবিল থেকে সবকিছু সরিয়ে নিন। সাবেকি আর আধুনিক মোমদানি পেয়ে যাবেন আপনার হাতের কাছেই কোনো দোকানে।
স্থপতি আছিয়া করিম তাঁর বাড়ির ড্রয়িংরুমে হলুদ আর সাদা আলো—দুটোই রেখেছেন। তিনি যখন খাবার পরিবেশ করেন, তখন হলুদ আলো জ্বালান। দীর্ঘ সময় বসে আড্ডার জন্য আবার হলুদ আলো উপযোগী নয়, সে সময় হলুদ আলো বন্ধ করে সাদা আলো ব্যবহার করেন।
খাবার টেবিলকে ফোকাস করে আলোকব্যবস্থা হিসেবে ঝুলন্ত বাতি বেশ জনপ্রিয়। টেবিল অনুযায়ী দুই থেকে তিনটি বাতি সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া যায়। টেবিল যদি লম্বালম্বি না হয়ে গোলাকার হয়, সে ক্ষেত্রে আলোর উৎসগুলো সারি বেঁধে না ঝুলিয়ে ত্রিভুজাকারে সাজানো যেতে পারে। তবে মাথায় রাখতে হবে, আলোর উৎস মানেই পোকামাকড়কে আমন্ত্রণ জানানো। সেটি যাতে না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। টেবিলের সবখানে সুন্দরভাবে আলো পড়ে, এমন একটি ফোকাল পয়েন্ট থেকে একটি পেনড্যান্ট বাতিও ঝুলিয়ে দিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন, বাতির শেডটি যেন নিরাপদ দূরত্বে থাকে।
আপনি চাইলে এই ডাইনিংয়েই মাঝেমধ্যে সেরে ফেলতে পারেন ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। সে ক্ষেত্রে সবার আগে টেবিল থেকে সবকিছু সরিয়ে নিন। সাবেকি আর আধুনিক মোমদানি পেয়ে যাবেন আপনার হাতের কাছেই কোনো দোকানে। পছন্দসই এক বা একাধিক মোমদানি কিনে রাখতে পারেন। সেখানেই পাবেন সুগন্ধী মোম। ফুলদানিতে রেখে দিন কয়েকটি মৌসুমি ফুল। অর্কিড, গোলাপ আর রজনীগন্ধা আপনার ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের সঙ্গী হতে পারে সারা বছর। হালকা, তৃপ্তিদায়ক খাবার বেছে নিন, যেন খাবারের চেয়ে মুহূর্তটাই মূর্ত হয়ে ধরা দেয়। আরামদায়ক পোশাক পরে প্রিয়জনকে সঙ্গী করে জ্বালিয়ে দিন মোমবাতি। হালকা কোনো মিউজিকও ছেড়ে দিতে পারেন।