আমার আসবাব হোক অন্যের চেয়ে আলাদা
অন্দরসাজের মতো আসবাবেও এখন প্রাধান্য পাচ্ছে স্বাতন্ত্র্যবাদ। প্রত্যেকেই চান তাঁর ঘরের আসবাবটি হোক অন্যের চেয়ে একটু আলাদা। শুধু নকশাই নয়, কী উপকরণে আসবাবটি তৈরি হবে, তা নিয়েও চলে গবেষণা। আসবাবে রঙের বাহুল্য থাকবে নাকি থাকবে রিকশাচিত্রের আবহ, এ নিয়েও আলোচনা কম হয় না। হাল জমানার আসবাবের মূল প্রবণতাগুলো জেনে নিন
নাবিলা নওরিন একজন উদ্যোক্তা। অন্যের বাসার অন্দরসজ্জা করতে গিয়ে এই স্থপতি দেখলেন, ক্রেতারা একটু ব্যতিক্রমী আসবাবের প্রতি বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কখনো আসবাবের নকশায়, কখনো রঙে, কখনো আসবাবের উপকরণে নতুনত্ব খুঁজছেন মানুষ। এ নতুন ধরনের চাহিদা দেখে আসবাব নিয়ে নিজেই কাজ শুরু করলেন নওরিন। গড়ে তুললেন আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘বহু’। যেখানে আসবাবে শুধু নকশাই নয়, মাল্টিফাংশনাল (একই আসবাবের বহুবিধ ব্যবহার) বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে বেশ। এই যেমন বসার ঘরের টেবিলের নিচের অংশে থাকছে পেপার রাখার ব্যবস্থা। একইভাবে পড়ার টেবিলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে ক্যাবিনেট।
আগে কাঠের জমকালো নকশার বিশালাকৃতির দোলনা কেবল অভিজাত অন্দরসজ্জায় দেখা যেত। সেখানে এখন পাটাতনের আদলে কাঠের তৈরি হালকা নকশার দোলনার ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। সোফার বিকল্প হিসেবে অনেকেই এখন এ ধরনের দোলনা ব্যবহার করছেন। এভাবে ড্রেসিং টেবিলের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে দেয়ালে বসানো আয়না। কখনো স্টিলের ট্রাঙ্ক বসার ঘরে টি টেবিল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হাতে আঁকা চিত্র দিয়ে ট্রাঙ্কেও আনা হচ্ছে নতুনত্ব।
হাতে আঁকা নকশার কথাই যখন এল, তখন বলি, আসবাবেও রংতুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে রিকশাচিত্র। আসবাবে রিকশা পেইন্টিংয়ের এ ব্যবহার জনপ্রিয় করে ফ্যাশন হাউস ‘যাত্রা’। প্রথম দিকে আয়না, জলচৌকির মতো ছোট ছোট আসবাব নিয়ে কাজ শুরু করে তারা। ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় আলমারি, ডাইনিং টেবিল, এমনকি খাটেও তুলে ধরা হয় রিকশাচিত্র। রিকশাচিত্রের পাশাপাশি আসবাবে যাত্রা আরও যুক্ত করেছে পটশিল্পের কাজ। যাত্রা ছাড়াও এখন অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে এ পেইন্টিং আসবাব নিয়ে কাজ করে। আসবাবে পেইন্টিং নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে একজন রাজিব কাজি। রাফি আর্ট গ্যালারি নামে অনলাইনে আসবাব পেইন্টিং নিয়ে কাজ করেন তিনি। তাঁর আসবাবে ফোক ধারার আঁকা প্রাধান্য পায়।
সঙ্গে পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি আসবাবে বাড়ছে ন্যাচারাল উড কালারের ব্যবহার। বাড়ছে সাদা রঙের আসবাবের জনপ্রিয়তাও। সব মিলিয়ে আসবাবে এত বৈচিত্র্য গত দুই দশকে খুব কম দেখা গেছে।
আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠান হাতিলের পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, গত ১০ বছরে আসবাবশিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগে আসবাব তৈরির সময় ভাবা হতো যেন দীর্ঘদিন তা টিকে থাকে। সেই টিকে থাকার সময় ৫০ বছর পর্যন্ত ধরে নেওয়া হতো। এখন মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক সচ্ছল। পাশাপাশি শৌখিনও। মানুষ এখন দীর্ঘস্থায়িত্বের চেয়ে নতুনত্ব চান বেশি। যে কারণে আসবাবে যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন নকশা।
নিজের আসবাব নিজেই তৈরি করে ঘর সাজিয়েছেন অন্দরসজ্জাবিদ সাবিহা কুমু। তিনি বলেন, ‘নিজে যেহেতু অন্দরসজ্জা নিয়ে কাজ করি, তাই চেয়েছিলাম আমার বাসার আসবাবগুলো যেন অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা হয়। দোকানে সে রকম আসবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন নিজেই আসবাবের নকশা করা শুরু করি।’
সাবিহা কুমুর নকশায় তৈরি প্রতিটি আসবাবই অন্য রকম। কাঠের আসবাবে বিশেষ এক ধরনের হ্যান্ডপলিশ করে কালো রং আনার চেষ্টা করেন তিনি। জানান, অ্যান্টিকের প্রতি আগ্রহ যাঁদের, তাঁরা এ ধরনের আসবাব পছন্দ করেন। কুমুর আসবাবেরও রয়েছে বিশেষ কিছু ক্রেতা, যাঁরা আসবাবে কালো রঙের ব্যবহার পছন্দ করেন। পুরোনো পদ্ধতিতেই হাতে পলিশের মাধ্যমে এসব আসবাব রাঙানো হয়। যে কারণে আসবাবগুলো পায় একটু অন্য রকম লুক। এসব আসবাবের সঙ্গে সাবিহা কুমু কখনো যোগ করেন টেরাকোটা, ‘লোকজ সংস্কৃতির প্রতি আমার বিশেষ টান আছে। সেই ভালোবাসা থেকেই আসবাবে টেরাকোটার সংযোজন।’
আগে মনে করা হতো ঘর তো ছোট, আসবাব রাখব কোথায়। তবে এখন ছোট ঘরই কীভাবে অল্প আসবাবে সেজে উঠবে, তা নিয়ে কাজ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ইশো তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে হালকা স্লিম ফিটের মাল্টিপারপাস বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আসবাবের নকশা করা হচ্ছে।
আবার ছোট ফ্ল্যাটের জন্য অনেকেই তৈরি করে নিচ্ছেন লো হাইট আসবাব। এসব নিচু আসবাব ঘরে বেশ খোলামেলা আবহ তৈরি করে। বসার ঘরে লো হাইট সোফা বা ডিভান, খাবার ঘরে লো হাইট টেবিল বা শোবার ঘরে কম উচ্চতার খাটের ব্যবহার এখন বেশ জনপ্রিয়। তবে এ ধরনের আসবাব ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের কিছু পরামর্শ রয়েছে। এই যেমন লো হাইট আসবাবেও উচ্চতার কিছু তারতম্য থাকে। তাই ঘরের আয়তনের ওপর নির্ভর করে আসবাবের উচ্চতা নির্ধারণ করতে হবে। একটু বড় ঘর হলে মেঝে থেকে হালকা উঁচু আসবাব বেছে নেওয়া ভালো। আবার ঘর যদি ছোট হয়, তবে মেঝে লাগোয়া আসবাবই ভালো দেখাবে।
বেতের আসবাবেও বেশ নতুনত্ব দেখা যাচ্ছে। শুধু বেতের আসবাবের নকশায় বৈচিত্র্য তো থাকছেই, সম্প্রতি কাঠের আসবাবেও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বেতের নকশা। কাঠের ডিনার ওয়াগনে আটকে দেওয়া হচ্ছে বেতের জালি। আবার বেত, কাঠ, মাটি—তিন উপকরণেও তৈরি হচ্ছে আসবাব। নতুন করে বেতের এ জনপ্রিয়তার কারণও কিন্তু সেই কাস্টমাইজড বা নিজস্ব নকশা।
এসব নিজের মতো আসবাব যে সব সময় দোকান থেকেই বানিয়ে নিতে হবে, তা কিন্তু নয়। কম দামি আসবাব ব্যবহার করেও কিন্তু আপনি কাস্টমাইজড আসবাব করতে পারেন। বসার ঘরে সব সময় যে সোফা থাকতে হবে, তা–ও নয়। ছোট ছোট টুলেও সাজতে পারে বসার ঘর। চাইলে বসার ঘরে খাটিয়ার ব্যবহার করতে পারেন। কম উচ্চতার পেইন্ট করা টেবিল এ ধরনের অন্দরসজ্জায় বেশ মানাবে।
অন্দরসজ্জায় এখন রিসাইকেল ব্যাপারটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরোনো শাড়ির কাপড় জোড়া দিয়ে তৈরি হচ্ছে সোফা। কাস্টমাইজড হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে এ ধরনের আসবাবের ব্যবহার। আবার কাজে লাগে না বলে পুরোনো অনেক জিনিস আমরা ফেলে দিই। চাইলে এসব অব্যবহৃত জিনিসও আসবাব তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারেন। এই যেমন কাপড়ে নকশা করার ব্লক। যদি বাড়িতে এ ধরনের ব্লক থাকে, তবে তা দিয়েই তৈরি করতে পারেন আসবাব। তবে সেখানে জমানোর ব্লকের পরিমাণ একটু বেশিই থাকতে হবে। এ ছাড়া অকেজো হয়ে যাওয়া পুরোনো আসবাব একটির সঙ্গে আরেকটি জুড়ে তৈরি করতে পারেন নতুন আসবাব।