নামকরা আসবাবের ব্যবসা বাড়ছে

চমৎকার নকশা ও মানসম্মত আসবাবের জন্য নগরবাসীর কাছে বেশ আগে থেকে জনপ্রিয় দেশি ব্র্যান্ড। ধীরে ধীরে মফস্‌সলেও ছড়িয়ে পড়ছে ব্র্যান্ডের আসবাব। তারপরও আসবাব খাতের ব্যবসার বড় অংশ এখনো নন–ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের হাতে। সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে কয়েক হাজার আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠান, যার অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র।

বর্তমানে দেশে আসবাবের বাজার কমবেশি ৩০ হাজার কোটি টাকা
ছবি: সুমন ইউসুফ

একসময় মানুষ পরিচিত কাঠমিস্ত্রি বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বাসাবাড়ির জন্য ফরমাশ দিয়ে খাট–পালঙ্ক, চেয়ার–টেবিল ইত্যাদি আসবাব বানাতেন। ধারাটি এখনো চালু আছে, তবে এর মধ্যেই নিত্যনতুন নকশা, মানসম্মত পণ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে ব্র্যান্ডের আসবাব। দেশের মানুষকে ব্র্যান্ডের আসবাবের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করায় অটবি, সেই ১৯৭৫ সালে। তারপর একে একে আসে আকতার ও হাতিল। তবে ব্যাপক হারে ২০০০ সালের পরই শুরু হয় ব্র্যান্ডের আসবাবের প্রসার।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘরবাড়ির পাশাপাশি অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মিত আসবাবের চাহিদা বাড়তে থাকে। এই চাহিদা কাজে লাগিয়ে নাভানা, পারটেক্স, নাদিয়া, ব্রাদার্স, হাইটেক, রিগ্যাল, জেএমজি, ইশো, বহুর মতো নতুন নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠছে। এসব ব্র্যান্ড রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ে ভালো ব্যবসা করছে। উপজেলা পর্যায়ে ব্র্যান্ডগুলোর উপস্থিতি এখনো কম।

স্বল্পতার কারণে দেশে কাঠের দাম বেশি। এ কারণে আমদানি করা কাঠের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বোর্ডে আসবাব তৈরি করে অধিকাংশ ব্র্যান্ড। মিয়ানমার, কানাডা, জার্মানি, নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সেগুন, মেহগনি, ওক, বিচ ওক প্রভৃতি কাঠ আমদানি করে ব্র্যান্ডগুলো আসবাব তৈরি করে।

আমদানি করা কাঠের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বোর্ডে আসবাব তৈরি করে অধিকাংশ ব্র্যান্ড
ছবি: সুমন ইউসুফ

আসবাব খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে দেশে আসবাবের বাজার কমবেশি ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্র্যান্ডের দখলে ৩৫ শতাংশ ব্যবসা। বাকিটা নন–ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের কাছে। সারা দেশে ছোট–বড় মিলিয়ে আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৪০ হাজার। এর মধ্যে ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান ১০০–এর কাছাকাছি।

আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে আসবাব তৈরিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, এমনকি রোবটও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। তবে আসবাব তৈরির জন্য কাঠসহ অন্যান্য কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কছাড় দিলে দেশি বাজারে ব্র্যান্ডের আসবাবের ব্যবসা বাড়বে। সরকারের রাজস্বও বাড়বে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

ব্র্যান্ড মানেই কি বেশি দাম

দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ দেশি ব্র্যান্ডের কাঠের তৈরি একটি খাটের দাম ৩০ হাজার টাকার ওপরে। পছন্দসই খাট কিনতে ৪০ হাজার টাকার ওপরে খরচ করতে হবে। আবার ব্র্যান্ডভেদে ছয় সিটের খাবার টেবিল কিনতে লাগবে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। ফলে ক্রেতাদের বড় একটা অংশ মনে করে, ব্র্যান্ডের আসবাবের দাম বেশি।

আসবাব তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়
ছবি: সুমন ইউসুফ

অবশ্য ব্যবসায়ীদের যুক্তি, দেশের আসবাব খাতের কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। কাঠ, বোর্ড থেকে শুরু করে কলকবজা, স্ক্রু, কাপড়, লেকার ইত্যাদি কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আর এসব কাঁচামাল আমদানিতে গড় শুল্ক ৫২ থেকে ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে কাঠ আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় ১০ থেকে ৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া বোর্ড, কাচ, চামড়া, ফোমসহ বিভিন্ন উপকরণ আমদানিতে প্রায় ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক রয়েছে।

আসবাব তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। দুই বছর আগেও ১ ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ৮৫–৮৬ টাকা। এখন সেটি বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। এতে করে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে আসবাবের দাম বেড়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কাঁচামালের আমদানিতে শুল্ক কমানো হলে কিছুটা কম দামে আসবাব সরবরাহ করা সম্ভব বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

আসবাব রপ্তানিতে পিছিয়ে দেশ

বাংলাদেশ থেকে আসবাব রপ্তানি গত এক দশকে আশানুরূপ বাড়েনি। যদিও বৈশ্বিক বাজারে বড় হচ্ছে। সম্ভাবনা থাকার পরও বাংলাদেশ রপ্তানি বাজারে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৩–১৪ অর্থবছরে ৪ কোটি ১৫ ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়েছিল। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৪ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৭৪ লাখ ডলারের আসবাব।

স্বল্পতার কারণে দেশে কাঠের দাম বেশি
ছবি: সুমন ইউসুফ

জার্মানিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুযায়ী, বৈশ্বিক আসবাবের বাজার চলতি বছর ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। এর মধ্যে শুধু শয়নকক্ষের আসবাবের বাজার ১৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। ২০২৯ সালে এই বাজার ৯২ হাজার ১০০ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। আসবাব রপ্তানিতে শীর্ষে চীন। এর পরে রয়েছে জার্মানি, ইতালি, ভিয়েতনাম, পোল্যান্ড, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও তুরস্ক।

হাতিল বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় আসবাব ব্র্যান্ড। সারা দেশে তাদের ৭৯টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। দেশের বাইরেও আসবাব রপ্তানি করছে হাতিল। ভারতে ১৮টি বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি হয় হাতিলের আসবাব।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে  বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান ও হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আসবাবের ব্যবসায় শ্লথগতি চলছে। তবে মনে হচ্ছে, এটি সাময়িক। সামগ্রিকভাবে দেশ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে সংস্কার শুরু হয়েছে। আশা করছি, সেটির ইতিবাচক প্রভাব ব্যবসা–বাণিজ্যে আমরা দেখতে পাব।’

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নীতিসহায়তা পেলে আসবাব রপ্তানি খুব অল্প সময়ে ১০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। বর্তমানে ৩৮টি দেশে শুল্কমুক্ত–সুবিধা পায় বাংলাদেশ। তবে কাঁচামালের উচ্চ আমদানি শুল্কের কারণে দেশের আসবাবশিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। একই কারণে রপ্তানি বাজারের প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে যাচ্ছে খাতটি।

সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে কয়েক হাজার আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠান, যার অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র
ছবি: সুমন ইউসুফ

আসবাব রপ্তানি বাড়াতে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটের আগে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউসের সুবিধা চান ব্যবসায়ীরা। প্রয়োজনে তাঁরা আমদানির জন্য শতভাগ ব্যাংক গ্যারান্টি দিতেও প্রস্তুত। তবে বন্ড–সুবিধার অপব্যবহার হতে পারে, এ আশঙ্কায় গত সরকার তা দিতে চায়নি।

সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘কাঁচামাল আমদানিতে বন্ড–সুবিধার জন্য আমরা ইতিমধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সঙ্গে বৈঠক করেছি। শিগগিরই আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে এ–সংক্রান্ত একটা প্রেজেন্টেশন দেব। আশা করছি, আমরা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাব। কারণ, শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি না করতে পারলে আসবাব রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতা করতে পারব না।’