ঢাকার যে অফিসে ক্যারম খেলতে খেলতে করা হয় জটিল সব সমস্যার সমাধান
ঢাকার ব্যস্ততম সড়ক কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ। তারই এক পাশে বাংলামোটরে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আস্থা আইটির সদর দপ্তর। অন্য রকমের এই অফিস দেখতে গিয়েছিলেন জাহিদ হোসাইন খান
১৩ তলার ওপর থেকে ঢাকা শহরটাকে অন্য রকম লাগে। মেট্রোরেল আর ব্যস্ত রাস্তার আবহ একদিকে, অন্যদিকে রমনার সবুজ। বৃষ্টি বা বাদলা দিনে ল্যাপটপের চেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছা করে বেশি। অফিসে প্রবেশ করতেই আমাদের আমন্ত্রণ জানায় বিশাল বারান্দা। দিনের পুরোটা সময় এখানে সূর্যের আলো খেলা করে। আস্থা আইটির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক খন্দকার মেহেদী হাসান বলেন, ‘কোনো কোনো দিন এই বারান্দা থেকে রংধনু দেখা যায়। সারা দিন শালিক কিংবা ময়নাসহ নাম না জানা অনেক পাখির কলকাকলি আমাদের পুরো অফিসটাকে প্রকৃতির অংশ করে রাখে।’
আরেক তরুণ পেশাজীবী তানজিলা আক্তার বলেন, ‘অফিস মানেই যে কাজের ব্যস্ততা—আস্থা আইটিতে এলে এই ধারণা অনেকটাই বদলে যায়। কোডিং দুনিয়া বাইনারি, শূন্য আর একের খেলা হলেও আমাদের অফিসে দেখা যায় রঙের বাহারি উপস্থাপনা।’
সিদ্ধেশ্বরী থেকে বাংলামোটর
২০০৭ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার সাধারণ একটি বাড়িতে যাত্রা শুরু করে আস্থা আইটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হাসনাইন রিজভী হাসান বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে থাকতে বাবা আমাকে একটি কম্পিউটার কিনে দিয়েছিল। ওই বছরই প্রোগ্রামিংয়ে আমার হাতেখড়ি। ২০০১ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হই। তত দিনে আমি চার-পাঁচটা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে পারদর্শী হয়ে উঠি। পড়ার সময়ই আমার তৈরি কমার্শিয়াল সফটওয়্যার বিক্রি করেছি। এরপর সুইডেনে ফ্রিল্যান্সিং কাজের সুযোগ পাই। সিদ্ধেশ্বরীর ছোট একটা ওয়ার্কস্টেশন শুরু হয় কাজ। ২০২৩ সালের মার্চে বাংলামোটরে আসে আস্থা।’
প্রতিষ্ঠানের নাম আস্থা কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এমন একটা সাধারণ বাংলা শব্দ আমি খুঁজছিলাম, যার সঙ্গে প্রযুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। যেটাকে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে চাইলে অন্যান্য ব্যবসাও করা যাবে। আর সেভাবেই আস্থাকে খুঁজে পাওয়া। সেই আস্থার জায়গা থেকেই পুরো অফিসটিকে সাজিয়েছি আমরা।’
উন্মুক্ত ভাবনা, উন্মুক্ত কাজ
আধুনিক কাজের দুনিয়ায় ওপেন স্পেস ডিজাইনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। হাসনাইন রিজভী হাসান বলেন, ‘শুরুর দিকে আমাদের ভাবনা ছিল, মানুষকে যেন একটু প্রশান্তি দেয় এই অফিস। সাধারণ করপোরেট অফিসের মতো একঘেয়েমি পরিবেশ যেন না তৈরি করে। সে কারণেই আমরা নানা প্রাকৃতিক বিষয়কে যুক্ত করেছি।’
প্রতিষ্ঠানটির ডিরেক্টর তাসনুভা আহমেদ বলেন, ‘অফিসের উন্মুক্ত পরিবেশে কাজের সঙ্গে মানুষের সংযুক্তি ঘটাতেই মিনিমাল আসবাব আর আলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটানো হচ্ছে।’
প্রতিষ্ঠানপ্রধান হাসনাইন রিজভী হাসান বলেন, ‘আমাদের অফিসের এক পাশে সবুজ বারান্দা আর বিশাল জানালা দিয়ে প্রকৃতিকে পাওয়া যায়। আমরা বিশ্বাস করি, মন প্রফুল্ল রাখতে এমন প্রকৃতিসংযোগ জরুরি। মাঝেমধ্যে যে এই শহরের বুকে রংধনুর দেখা মেলে, তা আস্থা আইটির সদর দপ্তর থেকে উপভোগ করেন একদল তরুণ পেশাজীবী।’
কাজের খেলা
তাসনুভা আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এখানে একটি গেম স্টেশন আছে। এটা সব সময় খোলা থাকে। খেলাধুলাকে কাজ কিংবা উদ্ভাবনের অংশ মনে করি আমরা। দেখা যায় টেবিল টেনিস কিংবা ক্যারম খেলতে খেলতে আমরা জটিল সব সমস্যার সমাধান করছি। অফিসে শুধু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই চলে না, কখনো একটু স্থিরতা কিংবা পাওয়ার ন্যাপ নেওয়ার সুযোগ তো দরকার।’
পুরো কাজের নকশা ও ভাবনা বাস্তবায়ন করেন স্টুডিও ওয়ান জিরোর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান স্থপতি জাফর হক ও হুমাইরা বিনতে হান্নান। স্থপতি জাফর হক বলেন, ‘অনেক বড় বড় অফিসে প্রবেশ করার পর আমরা কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যাই। কোথায় কোন দিকে যেতে হবে, বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। সেই দ্বিধা অবকাশ আস্থায় নেই। এখানে যেকোনো স্থানে কেউ দাঁড়ালে চোখের সামনে দেখতে পাবেন—কোথায় কোন রুম, কোন জায়গায় কীভাবে যেতে হবে। প্রথমবার অফিসে এসেও কেউ কোনো সংশয়ে পড়বেন না।’
কাজের রং
আস্থা আইটির সদরে রঙের বহুমাত্রিক ব্যবহার দেখা যায়। উজ্জ্বল রঙের মিলমিশ আর প্যাস্টেল শেডে প্রথম মনে হবে, ‘ভুলে কোনো আর্ট স্টুডিওতে এসে পড়িনি তো!’ লেমন গ্রিন, হালকা হলুদ আর প্যাস্টেল কমলার সংযোগে ১০ হাজার বর্গফুটের অফিসটিতে তৈরি হয়েছে স্থির আর নির্মল এক পরিবেশ। সবাইকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় এই তিন রং। সবুজে আসে স্থিরতা, হলুদে মেলে সূর্যের প্রাণময়তা আর কমলায় আছে শক্তি আর উচ্ছলতা। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাসনাইন রিজভী বলেন, ‘আমরা চাই, আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা উজ্জ্বল রং আর মিনিমাল ছায়ার আবহে নিজেদের সর্বোচ্চ সৃজনশীলতা নিয়ে কাজ করুক। প্রযুক্তিনির্ভর কাজ মানেই তো মগজ আর মননের সমন্বয়, সেই সমন্বয়কে উৎসাহিত করতেই এমন স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবেশ তৈরি করেছি।’
স্থপতি জাফর হক বলেন, ‘যতটা সম্ভব প্রকৃতির সংযোগ রেখে পরিচ্ছন্ন আঙ্গিকে অফিসটি সাজাতে চেয়েছি। প্রযুক্তি–দুনিয়ায় কর্মীদের অনেকটা সময় নিয়ে কাজ করতে হয়। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা হাঁটাচলা কিংবা চোখের প্রশান্তি আসে, এমন রঙে পুরো জায়গাটি নকশা করেছি। প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমরা বিভিন্ন দেয়ালে সৃজনশীল ও অনুপ্রেরণার নানা শব্দ গ্রাফিতি আকারে যুক্ত করেছি।’
পুরো অফিসের দেয়ালে দেয়ালে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের ছবি। আরও দেখা যায় নানা ধরনের অনুপ্রেরণামূলক বাক্যের চিত্রায়ণ। শিল্পকর্মের মাধ্যমে সৃজনশীলতাকে উপস্থাপনের চেষ্টা।
কাজের ফাঁকে
‘কর্মীদের মনন ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা বিশ্বাস করি, একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই সেই প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি ও ভাষা তৈরি করেন। নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষা উন্নত না হলে আমরা কীভাবে গ্রাহক পর্যায়ে দারুণ সব কাজ করব বলুন? আমাদের নিজেদের তৎপরতা বাড়ানোর জন্য আমরা কর্মীদের অনুপ্রাণিত করছি। আমরা কর্মস্থলকে আরেকটি বাড়ি মনে করি,’ এমনটাই বলেন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা তন্ময়কুমার কুন্ডু। কাজের জন্য সব সময় টেবিলমুখী না হয়ে পুরো অফিস দুবার চক্কর দিলে ৩০০ কদম হাঁটা হয়ে যায়। হাঁটলে মন ভালো থাকে, কাজ ভালো হয় বলে জানান আরেক প্রযুক্তি পেশাজীবী সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অনুপকান্তি কর। স্থপতি হুমাইরা হান্নান জানান, প্রশস্ত স্পেসে এখানে অনেক জায়গা খালি রাখা হয়েছে। পেশাজীবীদের জন্য কাজের পাশাপাশি হাঁটাচলা কিংবা একটু আড়মোড়া ভাঙার সুযোগ রাখা হয়েছে।
সংযুক্তিই যখন সব
আস্থা আইটিতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ থাকে। কেউ ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেন, কেউ ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষার্থী উমনুন বিনতে আলী বলেন, ‘প্রযুক্তি কিংবা প্রকৌশল মানেই মনে হয় যেন কোডিং, সার্কিট কিংবা বিশাল বিশাল মনিটর নিয়ে কাজ। আস্থার কর্মপরিবেশ ও ইন্টেরিয়র ভীষণ সুন্দর, কাজের জন্য প্রেরণাদায়ী। ইউটিউবে গুগল কিংবা অন্যান্য স্টার্টআপের অফিস যেমন দেখায়, আমাদের অফিস ও কাজের জায়গাটা তেমনই কিন্তু।’
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী জাকা জিসান সাইফ বলেন, ‘এখানে উন্মুক্ত কাজের পরিবেশ আছে বলে যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাই। আবার কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলে ছুটে যাই খেলার ঘরে। এখন টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট চলছে, তাই হাতের কাজ গুছিয়ে সেদিকেই ছুটব।’
দিনের বেলায় সূর্যের আলোর সংযোগের কারণে পুরো অফিসে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার কম থাকে। আবার রাতের বেলায় স্থির, নির্মল আর প্রশান্তিকর আবহে নানা লাইটের ব্যবহার দেখা যায়।