আমি যেভাবে বই পড়া বাড়ালাম
আমরা সারাক্ষণ ছুটছি। দাঁড়ানোর সময় তো নাই। এই প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রঙের ছড়াছড়ি। কনটেন্ট অক্ষর বা শব্দের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে। আগে ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের ভিডিও দেখা যেত। সেখান থেকে ১০-১২ মিনিটের ভিডিও হয়ে এখন এসেছে রিল। ৩০ সেকেন্ড কি, ৩ সেকেন্ডের মধ্যেই মনোযোগ আকর্ষণ করে ফেলতে হয়। তার মধ্যে আবার বই পড়া! এত সময় কোথায়? এ রকম একটা সময়ে, ২০২৪ সালে, মানে গত বছরে আমার বই পড়ার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। এর পেছনে কোনো রহস্য আদতে নেই। আমি কেন বই পড়তে চাই, কীভাবে ‘দৌড়ের ওপর’ বই পড়া বাড়ালাম, এসব বলতেই এই লেখা।
কেন বই পড়ি
হিসাবটা আদতে সোজাসাপটা। বই পড়তে চাই কি চাই না—এটাই প্রশ্ন। অনেকেই বলবেন, চাই না। কোনো কিছু জানতে ইন্টারনেট সার্চ করলেই তো হয়। সব তথ্য চলে আসে ঝাঁক বেঁধে। হালে চ্যাটজিপিটি বা এআই সেসব আরও গুছিয়ে দেয়। তাহলে পড়ার দরকার কী?
দরকার অনেক। ইংরেজিতে দুটি শব্দ আছে—ডেটা ও ইনফরমেশন। ডেটা মানে তথ্য, নানা রকম, নানা রূপের। সেখান থেকে কাজের জিনিসটা, অর্থবহ জিনিসটা বের করলে যা দাঁড়ায়, তার নাম ইনফরমেশন। ইন্টারনেটে সার্চ করলেন। এল অনেক তথ্য বা ডেটা। ইনফরমেশন এবং সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিজের খানিকটা জানাশোনা তো চাই। সে জন্য নানা দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বিষয় কেমন দেখায়, জানতে হবে সেটা। এই বিষয়টার খোঁজ মিলবে বইয়ে। চ্যাটজিপিটিকে বললেও পাওয়া যাবে, তবে সেই সিদ্ধান্তটা যে আমাদের নিজের হবে না, তা আর বলতে!
নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাধারা গড়ে তোলার জন্যও বই পড়া জরুরি। জরুরি কল্পনাশক্তি গড়ে তোলার জন্য। মুগ্ধ হওয়ার জন্য। শব্দ পড়ে সেটাকে মাথায় ছবির রূপ দেওয়ার যে শক্তি, চর্চা করে তাতে ধার দিতে হয়। নাহয় মরচে পড়ে যাবে।
এটুকু তো জ্ঞান, সেটা বুঝেশুনে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাধারা গড়ে তোলার জন্যও বই পড়া জরুরি। জরুরি কল্পনাশক্তি গড়ে তোলার জন্য। মুগ্ধ হওয়ার জন্য। শব্দ পড়ে সেটাকে মাথায় ছবির রূপ দেওয়ার যে শক্তি, চর্চা করে তাতে ধার দিতে হয়। নাহয় মরচে পড়ে যাবে। আর কেবলই ভিডিও দেখলে, যেখানে ছবিটা দিয়েই দেওয়া হচ্ছে, তখন আর গড়েই উঠবে না নিজের মাথায় ছবি আঁকার ক্ষমতা। ফলে কল্পনাশক্তি গড়ে উঠবে না। তাতে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার সম্ভাবনাটুকু নাই হয়ে যাবে অঙ্কুরেই। এসবই আমার মাথায় ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিল। কাজেই বই পড়ার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম শুরুতেই। সে জন্য সময় বের করা চাই।
রাতে যেভাবে পড়ি
ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বই পড়া যায় সহজেই। ক্লান্ত দেহের মতো মনেরও তো মলম চাই; গাছের গোড়ায় যেমন পানি দিতে হয়, তেমনি বই পড়া, মানে মাথাকে খানিকটা খাবার দেওয়া। এই খাবার আনন্দের, অফিসের চাপে চিঁড়েচ্যাপটা চিন্তাভাবনা নয়। এখানেই একটা বড় ঝামেলা টের পেলাম।
বই তো পড়াই যায়। কিন্তু বিছানায় শুয়ে পড়লে আবার উঠে বাতি নেভাতে ইচ্ছে করে না। এ কারণে একেবারে বাতি নিভিয়ে শোয়া, আর তাতে বই পড়ার সম্ভাবনাটিকেও গোড়ায় কেটে দেওয়া। সমস্যার সমাধান মিলল স্মার্ট লাইটে। দাম অত বেশিও নয়। শাওমিসহ অনেক কোম্পানিরই আছে। ফোন দিয়ে, মানে অ্যাপের মাধ্যমে বাতি জ্বালাও-নেভাও। তাহলেই তো আর উঠতে হচ্ছে না। আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংসের কল্যাণে শুধু বাতিই নয়, বাজারে আছে স্মার্ট ফ্রিজ, টিভি থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু।
রিমোট কন্ট্রোলড সুইচও পাওয়া যায়। বিকল্প ব্যবস্থা। স্মার্ট লাইট না কিনে ও রকম একটা সুইচ কিনে নিলে শুয়ে শুয়ে রিমোট চেপে চালানো যাবে পাখা, জ্বালানো যাবে বাতি।
এসব থেকে অনেক কম দামের সমাধান হলো রিডিং লাইট। ক্লিপের মতো একটা অংশ আছে, সেটা বইয়ে লাগিয়ে নেওয়া যায়। তারপর বাতি জ্বালালে আলোটা পড়বে শুধু পৃষ্ঠার ওপর। ছোট ল্যাম্পও আছে, সমাধান হিসেবে এসবও কোনো অংশে কম যায় না।
ই–রিডার কেন ভালো
আরেক ধাপ এগিয়ে, অনেক বই সহজে পড়ার ভালো উপায় ই-রিডার। যেমন কিন্ডল। বইয়ের মতোই। এই ডিভাইসটির দিকে তাকালে চোখে চাপ পড়ে না। এতে শুধু বই-ই পড়া যায়। চট করে তাই ফেসবুকে উঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। পড়াটা তাতে ভালো হয়। কিন্ডল ছাড়াও বুক্স, কোবো—এ রকম বেশ কিছু ই-রিডার আছে। দাম ১৫-২০ হাজারের মধ্যে। শুনে মনে হয় অনেক, তবে এটা এককালীন বিনিয়োগ, মুঠোফোন কেনার মতোই। চলবে বেশ কয়েক বছর।
কিন্ডল হোক বা কাগুজে বই, পড়া যায় চলতি পথেও। এটা আদতে পড়ার ভালো সময়। আমি নিজে মেট্রোয় উঠে অফিস আসার সময় ১০ মিনিট পড়ি, ফেরার সময় ১০ মিনিট। হয়ে গেল ২০ মিনিট! আরও কোথাও যেতে হলে, বাসে যাতায়াত এবং যানজট—এই দুইয়ের ‘কল্যাণে’ পড়ার সুযোগ মেলে (ভাগ্যিস, টানা পার্টিরা বাসের জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মুঠোফোনের মতো বই নিয়ে যায় না!)। আর রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়ার কথা তো আগেই বললাম।
কত পড়া যায়
পড়ার হিসাবটা এবার করি। গড়পড়তা। দিনে ১০ পৃষ্ঠা পড়লে বছরে পড়া যায় ৩ হাজার ৬৫০ পৃষ্ঠা। দিনে ২০ পৃষ্ঠা পড়লে মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ১৫০ পৃষ্ঠার প্রায় ৫০টা বই। আপনি যদি পড়ায় অভ্যস্ত না হন, কেবল শুরু করেছেন, সে ক্ষেত্রে প্রতি পৃষ্ঠা পড়তে ২-৩ মিনিট লাগলে, দিনে আপনাকে এক ঘণ্টা পড়তে হবে বড়জোর।
‘এত সময় কোথায়?’ বলে খারিজ করে দেওয়ার আগে একবার ভাবুন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি কত সময় ব্যয় করেন। পাশাপাশি এটাও ভাবুন, বই পড়া একধরনের বিনিয়োগ। আপনি যদি চাকরি করেন, কিংবা গবেষণা বা যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি কাজ, পড়ার অভ্যাস, কল্পনাশক্তি এবং মনোযোগ ধরে রাখা—এসবই আপনাকে সহায়তা করবে।
নিজের জন্য এতটুকু করতে চাইলে আর দেরি কেন? আজই শুরু করে দিন।