সাভারে মায়ের নামে বানানো মসজিদ পেল টাইম–এর স্বীকৃতি
টাইম ম্যাগাজিনের ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট প্লেসেস অব ২০২৫’ তালিকায় স্থান পেয়েছে সাভারের জেবুন নেসা মসজিদ। বৈশ্বিক এ তালিকায় প্রথমবার বাংলাদেশি কোনো স্থাপনা জায়গা পেল। জিনাত শারমিনকে মসজিদটি নির্মাণের গল্প শুনিয়েছেন স্থপতি সায়কা ইকবাল
ঢাকার যানজট ঠেলে যখন আশুলিয়ায় জেবুন নেসা মসজিদের সবুজ উঠানে গিয়ে দাঁড়াই, এক অদ্ভুত আনন্দে মনটা ভরে ওঠে। কয়েক কদম হেঁটে মসজিদ থেকে বাইরের লেকের দিকে তাকালেই ভুলে যাই, জায়গাটা একটি তৈরি পোশাক কারখানার প্রাঙ্গণ। যান্ত্রিকতার মধ্যে আসলে এমন কিছুই তো নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম।
একসময় উঁচু দেয়ালের কারণে কারখানার ভেতর থেকে পাশের লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত না। নকশা করার সময় সীমানাপ্রাচীর ভেঙে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, পশ্চিম পাশের এ লেক আশুলিয়ার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। একসময় এখানে চাষাবাদ হতো। দিনে দিনে শিল্পায়ন হতে হতে এলাকাটার আদি রূপের প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পেয়েছি এ লেককে।
মসজিদে প্রথমে যাঁরা যাবেন, এই স্থাপত্যকে তাঁরা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করার অনুভূতি পাবেন। সিঁড়ি বা র্যাম্প বেয়ে ওপরে উঠে চোখে পড়বে চতুর্ভুজ একটি প্যাভিলিয়ন ফর্ম। এই চতুর্ভুজের চারপাশে চারটি বাগান রেখেছি। চারটি বাগানের ভেতর সবচেয়ে বড়টি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। সেখানেই বাগানের ভেতর দিয়ে একটা ছাতিমগাছকে ঘিরে চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। ছাতিমগাছটা অনেকটা ছাতার মতো ছায়া দিচ্ছে। সেদিক দিয়ে ওপরে উঠলেই নারীদের নামাজের জায়গা। সেখান থেকে পশ্চিম পাশের লেকটা ভালোভাবে দেখা যায়। চতুর্ভুজ আকৃতির অবয়বের ভেতরে ঢুকলেই গোলাকৃতির বড় গম্বুজটার দেখা মিলবে। গম্বুজের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালে একটা শান্ত–শীতল বিশালত্বের খোঁজ পাই। সামনে তাকালে সেই বিশাল লেক।
মসজিদটা মনোলিথিক আর্কিটেকচারে গড়েছি। মনো মানে এক। মনোক্রোম রঙে বা এক রঙে রাঙা। ইসলাম ধর্মের মানুষেরা একজন সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। সেই ‘একক’ ব্যাপারটা এই স্থাপত্যেও উঠে এসেছে। সিমেন্ট, রং, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী সব স্থানীয়। মোজাইকে মার্বেলের বদলে ইটের টুকরা ব্যবহার করেছি। কারিগরেরাও সবাই দেশি। মসজিদটিকে তাই আমি বলি ‘লোকালি হ্যান্ড মেড’।
মসজিদের লালচে গোলাপি রংটা এই অঞ্চলের টেরাকোটা, চুনসুরকি ও বাংলার মৃৎ-স্থাপত্যের রং ও টেক্সচার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিয়েছি। ইসলামি স্থাপত্যে যে জালির ব্যবহার থাকে, এখানেও রেখেছি। তবে সেটি কেবল দেখার সৌন্দর্যের জন্য নয়; বরং প্রাকৃতিক আলো-বাতাস যথাসম্ভব ভেতরে ঢোকানোর জন্য। তাই মসজিদে কোনো শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখিনি। তবে মসজিদের ভেতরে সব সময় লেকের ওপর থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস ফিল্টার হয়ে চলাচলের ব্যবস্থা আছে। বেশ কিছু প্রজাতির স্থানীয় গাছ লাগানোর ব্যবস্থা রেখেছি। যেমন পশ্চিমে দুটি শিমুলগাছ আছে। সেই সঙ্গে নিচেও আছে লেমনগ্রাস, রেইন লিলিসহ নানা প্রজাতির গাছ। এমনভাবে গাছগুলো বাছাই করার চেষ্টা করেছি, যেন সারা বছর কিছু না কিছু রঙিন ফুল ফুটে থাকে। এ ছাড়া ঢোকার পথে, অজুখানার পাশেসহ বিভিন্ন জায়গায় বাঁশঝাড় লাগিয়েছি। এই বাঁশঝাড়ের মাধ্যমে গ্রামবাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঢুকে পড়েছে মসজিদ প্রাঙ্গণে।
জেবুন নেসা মসজিদ
আইডিএস গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানাটি আশুলিয়ার জামনগরে দরগার পাড়ে। এই কারখানায় আমাদের চারজন অংশীর স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্টুডিও মরফোজেনেসিস বেশ কিছু কাজ করেছে। এর মধ্যে টেকসই সবুজ কারখানা গড়ার কাজ অন্যতম। সেই ধারাবাহিকতায় কারখানা প্রাঙ্গণের ফাঁকা জায়গায় মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়েছিলেন শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইদ্রিস শাকুর। তাঁর সঙ্গে প্রাথামিক আলাপের পর একদিন ঘুরে আসি জায়গাটা। নকশা করব, তার আগে আইডিয়া নিয়ে প্রথম মিটিং হলো। আমার ভাবনা সবার সঙ্গে শেয়ার করলাম, সবার পছন্দও হলো। আইডিএস গ্রুপের অন্যতম পরিচালক রুখসানা কোয়েল শুধু বললেন, ‘একটা মেয়েও যদি এখানে নামাজ পড়তে আসে, সে যেন নিজের মনের মতো একটা জায়গা পায়।’ শুনে মনে হলো, এ তো আমারই মনের কথা!
২০১৯ সালের অক্টোবরে মসজিদের নকশা করার দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে দেওয়া হলো। সেই কাজ শেষে নির্মাণযজ্ঞ শুরুর পরপরই করোনার প্রকোপ বাড়ল। লকডাউনের মধ্যে সবকিছু থমকে গেল। দীর্ঘবিরতির পর ২০২১ সালের জুনে শুরু করতে না করতেই আবার কোভিডের নতুন ধরনের বিস্তারে মাস ছয়েকের জন্য বন্ধ হলো! ২০২২ সালে পুরোদমে কাজ শুরু হলো। কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল মাটির নিচে পাইপ, এলোমেলোভাবে ছড়ানো তার। তখন বিকল্পও ভাবতে হলো। এভাবেই একসময় পুরো কাঠামো পূর্ণতা পেল।
এই প্রকল্পে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজটা ছিল অনেকটা সিনেমার পরিচালকের মতো। স্থাপতি হিসেবে কেবল নকশা করা নয়, প্রতিটা বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে, প্রত্যেককে বুঝিয়ে কাজটা বের করে আনার গুরুদায়িত্বও ছিল আমার কাঁধে। ডিজাইন পার্টনার হিসেবে শুভ্র শোভন চৌধুরীও যুক্ত ছিলেন। তিনি নির্মাণ কেমন হবে, তার ডিটেইলস নিয়ে কাজ করেছেন। সহযোগী স্থপতি হিসেবে কাজ করেছেন মুনতাসির হাকিম। মসজিদের স্বচ্ছ কাচের মিহরাব বানানো হয়েছে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের সহযোগিতায়।
ইদ্রিস শাকুরের মায়ের নামে মসজিদটির নাম জেবুন নেসা মসজিদ। আসলে নামের ভেতর দিয়ে এই মসজিদের সঙ্গে জুড়ে গেছে মাতৃত্বের কমনীয়তা।
অনেকেই আসেন দেখতে
মসজিদটি বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকীর ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট প্লেসেস অব ২০২৫ ’-এর ১০০ তালিকার অংশ হবে কখনো ভাবিনি। তারাই আমার মসজিদটিকে খুঁজে বের করেছে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এই স্বীকৃতির আগে মসজিদটির জন্য আমি ভারতের জেকে সিমেন্ট লিমিটেডের ৩৪তম পুরস্কার আয়োজনে ‘আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার’ সম্মাননা পেয়েছি। অনলাইন আর্কিটেকচার প্ল্যাটফর্ম ডিজিন থেকে ‘টপ ফাইভ সিভিক প্রজেক্টস’ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আর্ক ডেইলির ‘টপ ফাইভ রিলিজিয়াস প্রজেক্ট’-এও নির্বাচিত হয়েছে জেবুন নেসা মসজিদ।
প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কর্মী এই তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তাঁদের জন্যই এই মসজিদ। তবে বাইরে থেকে গিয়েও সেখানে নামাজ পড়তে পারেন।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকেও মানুষ মসজিদটি দেখতে আসছেন। মার্কিন স্থপতিদের একটি দল মসজিদটি ঘুরে গেছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে এক নারী এই মসজিদে এসে নামাজ পড়ে গেছেন। আবার লন্ডনে ফিরে গিয়ে ইনস্টাগ্রামে বার্তা পাঠিয়েছেন। একজন ফরাসি স্থপতিও ঘুরে গেছেন। আমাকে লিখেছেন যে তাঁদের ভালো লেগেছে। একটা স্থাপনা যখন দেশ, ভাষা, সংস্কৃতির গণ্ডি পেরিয়ে অন্যদেরও ভালো লাগে, তখন মনে হয়, কাজটা আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে। স্থপতি হিসেবে এটাই আমার পরম পাওয়া।