আগের মতো আর বিয়ের কাজ পাই না
ছেলেবেলায় ফুলের দোকানে কাজ করতেন। এখন নিজেই একটা দোকানের মালিক। নিজে যেমন নকশা করেন, তেমনি আয়োজকদের সরবরাহ করা নকশাও ফুলে ফুলে ফুটিয়ে তোলেন। রাজধানীর শাহবাগের পুষ্পসজ্জাকর জসিম উদ্দিনের গল্প শুনেছেন সজীব মিয়া
দোকানের সামনেই ফুল দিয়ে সামিয়ানা তৈরির কাজ করছিলেন জসিম উদ্দিন। বেলির লহরগুলো কাঠের কাঠামোয় লম্বালম্বি বিছিয়ে দিয়েছেন। এখন স্কচটেপ দিয়ে কাঠামোর চারপাশে গ্লাডিউলাস, জারবেরা, গোলাপ, রজনীগন্ধা লাগিয়ে দিচ্ছেন। গায়েহলুদে কনেকে যখন মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে, সেসময় সামিয়ানাটা মাথার ওপর ধরা হবে।
আগে দোকানটার নাম ছিল ‘ফুলতলা ফ্লাওয়ার শপ’, মালিকানা ভাগ হয়ে এখন হয়েছে ‘মাহমুদা পুষ্পালয়’। বড় ভাইকে অংশীদার করে দোকানটা দিয়েছেন জসিম। বড় ভাই অংশী হলেও কারিগর তিনিই। ৩০ বছর ধরে গায়েহলুদ, বউভাত, ফুলসজ্জাসহ নানা অনুষ্ঠানকে পুষ্পশোভিত করেন জসিম।
আলাপের শুরুতেই তাঁর আক্ষেপ—‘আগের মতো আর বিয়ের কাজ পাই না।’ কেন পান না? জবাবে শোনালেন দীর্ঘ গল্প। মোদ্দা কথা হলো, ঢাকাসহ বড় শহররগুলোর বিয়ের অনুষ্ঠান এখন কমিউনিটি সেন্টার, ক্লাবের হাতে চলে গেছে। এসব জায়গায় কাজ পেতে তালিকাভুক্ত হতে হয়, দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। সে কারণে কাজগুলো বেহাত হয়ে গেছে।
তবে এরমধ্যেও বসে নেই জসিম উদ্দিন। বিয়ের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে ফুল সরবরাহ করছেন। জসিম উদ্দিনের ভাষায়, ‘মানুষের জন্মের সময়ও আমাদের লাগে, বিয়ের সময়েও লাগে, মারা গেলেও লাগে!’
জসিম উদ্দিনের বাড়ি বরগুনা। ১৯৮৭ সালে ৯ বছর বয়সে ঢাকায় আসেন। কাঁটাবনের ফুলের দোকানে কাজ করতেন তাঁর মেজো ভাই। সেখানেই সহকারীর কাজ নেন জসিম উদ্দিন। ‘স্বপ্নের ঠিকানা’র মালিক ছিল তার ভগ্নিপতি। শুরুতে ফুল কাটা, ফুল বাছা এসবই করতেন। পরে ফুলসজ্জার কারিগরের কাজে সহায়তা করার সুযোগ পান। এভাবেই একদিন তোড়া বানানো শিখলেন। আরও পরে শিখলেন বিয়ের গাড়ি সাজানো, বিয়ের গেট–মঞ্চ সাজানো।
১৯৯৮ সালে মুক্তি পায় রাঙা বউ। সিনেমাটির সাজসজ্জার কাজ করেছেন জসিম উদ্দিন। কারিগর হিসেবে এটাই তাঁর প্রথম বিয়ের কাজ। জসিম উদ্দিন বলছিলেন, ‘তখন মাত্রই কাজ শিখছি। তার মধ্যে জনপ্রিয় সব নায়ক–নায়িকাদের সঙ্গে কাজ। আলাদা একটা আনন্দ হয়েছিলো। সিনেমার বিয়ে হলেও গেট–গাড়ি–বাসরঘর সাজাতাম যত্ন নিয়ে।’
দোকান না বদলাইলে বেতন বাড়ে না
২০০০ সালের দিকেও শাহবাগে হাতে গোনা কয়েকটা ফুলের দোকান ছিল। ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ ছেড়ে তেমনই একটি দোকানে চাকরি নেন জসিম উদ্দিন। ভগ্নিপতির দোকানে বেতন ছিল ৬০০ টাকা। নতুন দোকানে বেতন হলো ৬ হাজার টাকা। জসিম বলছিলেন, ‘দোকান না বদলাইলে বেতন বাড়ে না। তত দিনে বড় হইছি, কাজ শিখছি, তাই বাধ্য হয়েই দোকান বদল করছি।’
শাহবাগে চাকরির সময়ই কিছুদিন চট্টগ্রাম আর সিলেটের দুটি ফুলের দোকানে কাজ করেছেন। এরপর শাহবাগেই থিতু হয়েছেন। একযুগ আগে কয়েকজনের সঙ্গে একটা দোকান দেন। দিনে দিনে ব্যবসা উন্নতি করেছে। এখন দুজনের দোকান। দেশি–বিদেশি হরেক জাতের ফুল বিক্রি করেন। দোকানে কর্মী রেখেছেন। তবে এখনো বড় কাজ পেলে নিজেই করেন।
জসিম উদ্দিন বলছিলেন, ‘আগে ছিল ঝরনা বাসরঘর। খাটের চারপাশে ফুলের লহর ঝুলিয়ে দিতাম, ব্যাস হয়ে গেল।’
আর এখন?
পাশে রাখা ল্যাপটপ, ট্যাব আর অ্যালবাম দেখিয়ে বলেন, ‘নানা নকশা। কত রকমের কাজ যে করতে হয়। তাই ট্যাব নিয়ে ঘুরি।’
জসিমেরা মূলত ভারতীয় নকশা দেখে কাজ করেন। কেউ নকশা সরবরাহ করলে সেভাবেও সাজিয়ে দেন। ফুল আর নকশার ওপর নির্ভর করে দর। গাড়ি সাজাতে ২ হাজার থেকে লাখ টাকাও নেন। ফুলসজ্জার কাজ যেমন করেন দুই থেকে ৫০ হাজার টাকায়। গায়েহলুদও ৫–১৫ হাজারে। বিদেশি ফুল ব্যবহার করলে দাম আরও বেড়ে যায়।