কীভাবে বুঝবেন কাছের মানুষটি আত্মহত্যার কথা ভাবছে

আত্মহত্যা লক্ষণ কারও মধ্যে দেখা দিলে মোটেও জাজমেন্টাল হওয়া যাবে না।
ছবি : প্রথম আলো

‘মনের আঘাতকে কেউ পাত্তা দেয় না। না হলে একটা মানুষ বিষণ্নতায় থেকে আত্মহত্যা করে ফেলে আর কাছের মানুষেরা টেরই পায় না যে মানুষটার মনে কিছু ঘটছে।’ এই লেখা যখন লিখতে বসলাম ঠিক তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন একটি স্ট্যাটাসের দিকে চোখ পড়ল।

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক কর্মীর মৃতদেহ পাওয়া যায় হাতিরঝিলে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় যে বিষণ্নতা থেকে আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাসগুলোয় দেখা যায়, অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে মেয়েটির বিষণ্নতার কথা কেউ কি জানার চেষ্টা করেননি? নাকি কাছের মানুষেরা বিষয়টি বুঝতেই পারেননি যে তিনি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন?

সম্প্রতি এই ঘটনা মনে করিয়ে দিল প্রেরণা খন্দকারের কথা। দেশের একটি পাঁচ তারকা হোটেলের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কাজ করতেন তিনি। শখের বশে টুকটাক মডেলিংও করতেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির এক মধ্যরাতে আত্মহননের পথ বেছে নেন এই তরুণী। প্রেরণার পরিবার অত্যন্ত উদারমনা। মা, বাবা, ভাই–বোনদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল বেশ। ঠিক কী কারণে মেয়েটি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন বা পরিবারের সবাই এত বন্ধুসুলভ হওয়ার পরও কেন টের পেলেন না, এই ভাবনা এখনো ভাবিয়ে তোলে।

সব সময়ই যে আত্মহননকারী ব্যক্তির আচরণগুলো নেতিবাচক হবে, তা কিন্তু নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে যে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, অনেক সময় তিনি পরিকল্পনা করেই জীবনের বাকি দিনগুলো আনন্দে কাটাতে চান। এমনটাই বলছিলেন শান্তিবাড়ির সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর ও সাইকোলজিস্ট রাজিয়া সুলতানা। হয়তো বাড়িতে ফিরে উচ্চস্বরে গান করবেন বা শুনবেন, নাহলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। আসলে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি বেশ জটিল। কে কখন কী কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেয়, বাইরে থেকে তা বোঝা বেশির ভাগ সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বলে জানান এই মনোচিকিৎসক।

তারপরও যদি কাছের কারও আচরণে হঠাৎ করেই অন্য রকম কিছু পরিলক্ষিত হয়, তাহলে খুব দ্রুত বিষয়টা নিয়ে তাঁর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা ভালো। সেই ব্যক্তির আচরণ বা কথাবার্তা যদি সন্দেহজনক বা অসংলগ্ন মনে হয়, তাহলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এ ছাড়া বন্ধু হলে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে, সহকর্মী হলেও অন্য কোনো বিশ্বস্ত সহকর্মীর সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে।

রাজিয়া সুলতানা জানান, ঠিক কোন কোন লক্ষণ দেখলে বুঝবেন যে আপনার কাছের মানুষটি যেকোনো সময় আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেন।

  • যদি দেখেন, কোনো কারণ ছাড়াই কাছের কোনো মানুষের আচরণে বিরাট পরিবর্তন আসছে। এই যেমন হাইপার অ্যাকটিভ হয়ে উঠছেন, নয়তো অনেক বেশি চুপচাপ হয়ে গেছেন।

  • সবকিছুতেই যখন বলছেন, ভালো লাগছে না।

  • কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। কোনো বিষয় নিয়েই ইতিবাচক নন। সব বিষয়েই নেতিবাচক কথা বলছেন।

  • দৈনন্দিন রুটিনে ব্যাঘাত ঘটছে। এই যেমন ঠিকমতো ঘুমাচ্ছেন না, খাওয়াদাওয়া করছেন না বা পরিবারের কোনো বিষয়েই মাথা ঘামাচ্ছেন না। অফিসেও ঠিক সময়ে উপস্থিত হচ্ছেন না।

  • হঠাৎ করেই অনেক বেশি আনন্দ করছেন বা হঠাৎ করেই অনেক বেশি হাসিখুশি হয়ে গেছেন। ঘরে ফিরে উচ্চস্বরে গান শুনছেন, অনেক সময় ধরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বা বাইরে খেতে যাচ্ছেন।

  • ফেসবুকে হতাশামূলক স্ট্যাটাস দিচ্ছে বা জানান দিচ্ছেন যে তিনি মানসিকভাবে ভালো নেই।

মনোবিজ্ঞানে একটা কথা বলা হয়; মানুষ কখনো জানিয়ে আত্মহত্যা করে না। তবে ইদানীং কেউ আত্মহননের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ফেসবুকে তার কিছুটা আভাস দিয়ে থাকেন। রাজিয়া সুলতানার মনে হয়, কাছের কাউকে হয়তো সরাসরি বলার সাহস হয় না, তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা মানসিক সহযোগিতার আশা করেন।

আবার হয়তো বা ভেবে থাকেন যে কেউ হয়তো তাঁকে মানসিক সহায়তা দেবেন। আর এ ধরনের কোনো লক্ষণ কারও মধ্যে দেখা দিলে মোটেও জাজমেন্টাল হওয়া যাবে না। বরং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। হাতে হাত রেখে তাঁর মনের কথা শুনতে হবে। আর প্রয়োজন মনে হলে অবশ্যই মনোচিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।