নিজেকে মনে হয়েছে পুতুল, যেন আমরা গান লিখিনি, গানটিই আমাদের লিখেছে
মাত্র ২২ বছর বয়সেই পেয়ে গেছেন ২টি অস্কার, ২টি গোল্ডেন গ্লোব আর ৯টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। এত অল্প বয়সে একাধিক অস্কারজয়ী শিল্পী হিসেবে এ বছর রেকর্ড গড়েছেন। শুধু পুরস্কার নয়, বার্বি সিনেমার ‘হোয়াট আই ওয়াজ মেইড ফর?’ গানটি দিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়নও তুলেছেন বিলি আইলিশ। গানটি লেখার গল্প ও তাঁর লেখালেখির স্মৃতি নিয়ে সম্প্রতি ভ্যানিটি ফেয়ার সাময়িকীতে একটি বিশেষ কলাম লিখেছেন এই মার্কিন সংগীতশিল্পী। আজ থাকল তারই নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।
মা আমাদের বেশ মজার মজার কায়দায় গান লেখা শেখাতেন। ১১ থেকে ১২ বছর বয়সে যখন গান লেখা শুরু করি, তখন ভাই ফিনেস আর আমাকে লেখার চর্চা করার জন্য মা সিনেমা দেখতে বলতেন। আর বলতেন সিনেমা দেখে ওটার ব্যাপারে কাগজে টুকে রাখতে। কী হলো পর্দায়? কোন চরিত্র কী বলল? দৃশ্যের ফাঁকে কি কোনো মজার কিছু চোখে পড়ল? মোটকথা, যা-ই মাথায় গেঁথে যেত, তা-ই টুকে রাখতে বলতেন মা। এরপর ওই টুকে রাখা শব্দ দিয়ে গান লিখতে বলতেন। লেখালেখির হাতেখড়ির সেই দিনগুলো থেকেই সিনেমার দৃশ্য ধরে ধরে গান লেখার অভ্যাস। একটা সময় যখন আদতেই হলিউড সিনেমার গান লেখার সুযোগ পাই, তখন মনে হয়েছিল, ‘আরে! এটা তো আমার খুব ভালো করেই জানা। আমার রক্তেই আছে গান লেখা।’
অনেক সিনেমাপ্রেমী এক জীবনে হাজারো সিনেমা দেখে ফেলেন। কিন্তু আমি ভালো লাগার একটা সিনেমা হাজার হাজারবার দেখি, দেখতেই থাকি। এটাই আমার সিনেমা দেখার ধরন। আমি এক সিনেমা বারবার দেখা দর্শক। আর সেই সব সিনেমাই বেশি টানত, যার গান আমাকে আকৃষ্ট করত। মনে আছে, ব্রায়ান অ্যাডামসের কাজের প্রেমে পড়েছিলাম স্পিরিট: স্ট্যালিয়ন অব দ্য সিমারন সিনেমাটা দেখে। একইভাবে ওভার দ্য হেজ সিনেমা দেখে বেন ফোল্ডের ভক্ত হই। এরপর জীবনে আসে আমেরিকান বিউটি সিনেমার সংগীত। আচমকাই কোনো এক জায়গায় এই সিনেমায় টমাস নিউম্যানের করা একটি সুর শুনেছিলাম। ওই এক সুর শুনে পুরো অ্যালবাম ডাউনলোড করে নিয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত ওই অ্যালবামের যন্ত্রসংগীত আমার অন্যতম প্রিয় সুর। ওটাই আমার জীবনের মোড় বদলে দিয়েছিল। আমাকে বুঝিয়েছিল সিনেমা আর টেলিভিশনে সুর ও সংগীত কতটা জরুরি।
একজন সংগীতশিল্পীর কাছে জেমস বন্ডের জন্য গান বানানোর সুযোগ পাওয়া এক দারুণ ব্যাপার। তার ওপর আমরা (আমি আর আমার ভাই) ছিলাম বন্ডের ভক্ত। তাই বন্ড সিনেমার জন্য গান লেখার আগে প্রচুর অনুশীলন ও মহড়া করেছি। স্বপ্ন দেখতাম, কোনো একদিন সিনেমার শেষ দৃশ্যের পর পর্দা নামার সঙ্গে সঙ্গে আমার বানানো গান বেজে উঠবে, অথবা সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের পেছনে আমার সৃষ্টি করা সুর যোগ হবে। সেই স্বপ্নটাই যখন সত্যি হলো, যখন সত্যিই আমি সিনেমার জন্য গান বানানোর সুযোগ পেলাম, কী যে বিস্মিত হয়েছিলাম। এরপর যতবার সিনেমার জন্য গান বানানোর সুযোগ পেয়েছি, অনুভূতিটা প্রতিবারই ছিল প্রথমবারের মতো। বিস্ময়ে ভরা!
কখনোই গানে নিজের অনুভূতিকে তুলে ধরতে চাই না। কখনো করেছি বলে মনেও পড়ে না। বরং বলব, এমনটা করতে আমার বিরক্ত লাগে। আমার মনে আজ কী চলছে, এটা জেনে কার কী আসে যায়? এ জন্যই যখন বার্বি সিনেমার ‘হোয়াট আই ওয়াজ মেড ফর?’ গানটি লিখছিলাম, তখন নিজের কিংবা নিজের জীবনের সঙ্গে এর কোনো অংশকে মেলাতে যাইনি। আমার মাথায় শুধু ছিল সিনেমার ওই চরিত্রের ভেতরের অবস্থা। কিন্তু লেখার পর অদ্ভুতভাবে উপলব্ধি করলাম, নিজেকে ভেবে না লিখলেও গানটি যেন আমার অনুভূতির কথাই বলছিল। এমনটাই হয়, গান লেখার সময় শুধু সিনেমার কাল্পনিক চরিত্রকে ভেবে লিখি, কিন্তু শেষে গিয়ে দেখা যায় চরিত্রটি আদতে আমি।
মজার ব্যাপার হলো, বার্বির এই গান লিখতে গিয়ে একটুও চাপ মনে হয়নি। নিজেকে মনে হয়েছে পুতুল, যেন আমরা গান লিখিনি, গানটিই আমাদের লিখেছে।
‘হোয়াট আই ওয়াজ মেইড ফর?’ গানটি মুক্তির পর এক সপ্তাহ আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। রাত জেগে শুধু ভক্তদের বানানো ভিডিওগুলো দেখতাম। আমার গান মানুষের জীবনের অংশ হয়ে উঠছে, একজনকে আরেকজনের কাছে আনছে, স্মৃতি হয়ে উঠছে—এটা দেখতে পারা যে কত আনন্দের, বলে বোঝাতে পারব না।
একজন তরুণ নারী শিল্পী হিসেবে আমাকে প্রায়ই মানুষের তীব্র অসন্তোষ আর বিরক্তির সঙ্গে লড়তে হয়। পৃথিবী এখন এই নিয়মেই চলছে। শরীরের আকার, চেহারা, আমার সামর্থ্য, যোগ্যতাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। কোনো পুরুষ সহকর্মীকে এমন তীব্র সমালোচনার সঙ্গে কখনো লড়তে দেখি না। ‘হোয়াট আই ওয়াজ মেইড ফর?’ গানটি মুক্তির পর উপলব্ধিগুলো আরও প্রখর হয়েছে। যখন শুনেছি বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা শ্রেণি-পেশার নারীরা এই গানের সঙ্গে নিজেদের জীবনের সংগ্রামকেও মেলাচ্ছে, তখন থেকে নারী হিসেবে নিজের একাকিত্ব-অসহায়ত্ব একটু হলেও কম মনে হয়েছে।
‘হোয়াট আই ওয়াজ মেইড ফর?’গানের ভিডিও আমি পরিচালনা করেছি। জীবনের সেরা কাজের একটি হয়ে থাকবে এই ভিডিও। আমার মতো নবীন পরিচালকের জন্য কাজটা সহজ ছিল না। জানতাম, আমি কী বানাতে চাই। কিন্তু কীভাবে বানাব জানতাম না। কল্পনা করা দৃশ্যগুলো আমার কাছে স্পষ্ট ছিল, কিন্তু সেগুলোকে বাস্তব করা ছিল জটিল ধাঁধার মতো। অনেক সময় বুঝতে পারি না, কী করব? কী করছি? না বুঝেই তখন কী না কী করি! তখনো মানুষ এসে আমাকে বলে, ‘দারুণ করছ। চালিয়ে যাও।’ কিন্তু আমি এটা চাই না। আমি চাই, যদি ভুলভাল কিছু করি, লোকে এসে বলুক। আমি শিখতে চাই।
ইংরেজি থেকে অনুদিত