বটের ছায়ায় ছায়ানট
পয়লা বৈশাখ আর ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান যেন একই সূত্রে গাঁথা। পঞ্জিকার প্রথম দিনটির কথা মনে এলেই চোখে ভাসে রমনা বটমূলে কয়েক সারিতে বসা শিল্পীদের চেহারা। একক এবং সম্মেলক গানের মাধ্যমে ভোরটা সকাল হতে থাকে। মাঝেমধ্যে কথন, আবৃত্তি সেই গানের আবহে ভিন্নধর্মী রস সিঞ্চন করে। ঢাকা মহানগরীর নানা জায়গায় এখন বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়, তারপরও ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ এখনো নান্দনিকভাবে অন্য মাত্রার সন্ধান দেয়। ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি শুধু হাসি–গান–খেলায় সীমাবদ্ধ নয়। জাতীয় জীবনের এক অস্বাভাবিক অভিঘাতে জন্ম হয়েছিল এই সংগঠনের। তাই আমাদের নানা জাতীয় সংকট নিরসনে ছায়ানট রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা, সে–ও গানেরই পথ ধরে। সেদিকে একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক।
জন্ম
ছায়ানটের জন্ম হয়েছিল সামরিক আইনের থমথমে পরিবেশের মধ্যে। ১৯৬১ সালের আগে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গিয়েছিল এই ভূখণ্ডে। ১৯৪৮ থেকে ’৫২–এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা (যদিও তা কার্যকর হয়নি) তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো। সেটা বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হওয়ার কাল। এ রকম একটা সময় পাকিস্তানে গণতন্ত্রের যে ছিটেফোঁটা ছিল, তা–ও কেড়ে নেওয়া হলো সেনাবাহিনী মারফত। জনসাধারণ কিন্তু তাতে দমে যায়নি। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া আইয়ুব খানের কড়া শাসনকালেই দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করছিল। ঠিক এই বৈরী পরিবেশে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালনের ভাবনা এসেছিল কিছু মানুষের মনে। বলা যায়, সে ভাবনাই ছায়ানটের অঙ্কুরোদ্গমের পথ প্রশস্ত করেছিল।
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হলো। নানা ধরনের বিরোধিতার পরও সে অনুষ্ঠান হলো সফল। শতবার্ষিকী পালনের পর সাংস্কৃতিক সংগঠক মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই) ও তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহার রহমান (রোজবু), সুফিয়া কামাল, আহমেদুর রহমান (ইত্তেফাক–এর ভিমরুল), সয়ীদুল হাসান, ফরিদা হাসান, ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফুদ্দীন আহমেদসহ (মানিক) অনেকেই গেলেন বনভোজনে, জয়দেবপুরে, ভাওয়াল এস্টেটের ম্যানেজার বাড়ির আঙিনায়। সেখানে বসেই নানা কথার পর সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটা সমিতি গঠন করা হলো। সেটাই ছায়ানট। সভাপতি হলেন সুফিয়া কামাল। সাধারণ সম্পাদক ফরিদা হাসান। ফরিদা হাসানের স্বামী সয়ীদুল হাসানই সংগঠনের নাম দিলেন ছায়ানট। (ওয়াহিদুল হক, ছায়ানট: আরম্ভ কথা/স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা, পৃষ্ঠা ৫১)
রবীন্দ্রনাথই ছিলেন সূচনার প্রেরণা, তবে ছায়ানট সংঘবদ্ধ হলো বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলার জন্য। ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে। সেটি ছিল পুরোনো গানের আসর। পরিচালনা করেছিলেন আবদুল আহাদ। সারা বাংলার বিশিষ্ট সুরকার, গীতরচয়িতাদের সংগীতের ভেতর দিয়ে বাঙালি ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে অনুষ্ঠানে।
পশ্চাৎপট এঁকেছিলেন নিতুন কুন্ডু, পরামর্শক ছিলেন দেবদাস চক্রবর্তী। সেটা ছিল মঞ্চজোড়া নৃত্যরত রবী–বাউল—অবনীন্দ্রনাথের মূল জলরং থেকে নেওয়া হয়েছিল ছবিটি। (ওয়াহিদুল হক, ছায়ানট: আরম্ভ কথা/স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা, পৃষ্ঠা ৫২)
প্রথম অনুষ্ঠানের পর নানা ধরনের সাংগঠনিক অসুবিধায় বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল ছায়ানটের কার্যক্রম। পরে কামাল লোহানী হলেন সাধারণ সম্পাদক, তবে কর্ম সম্পাদনের দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল সবার ওপরই।
ছায়ানটের মূল প্রাণশক্তি ছিল এর নিবেদিত কর্মী বাহিনী। সংগীতের মাধ্যমে রুচিগঠনের কাজটি করেছে ছায়ানট। ৩১ নম্বর র৵াঙ্কিন স্ট্রিটে মোখলেসুর রহমানদের (সিধু ভাই) বাড়িতেই ইংরেজি ‘এল’ ছাঁদের বড় একটি ঘরে ছোট্ট মঞ্চ তৈরি করে ঘরোয়াভাবে গান পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে প্রথম অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছিলেন কলকাতা থেকে আগত শিল্পী ফিরোজা বেগম। পরের আসরে গান করলেন ফাহমিদা খাতুন। এরপরের আসরে হলো উচ্চাঙ্গসংগীত। প্রথমে সেতার, বাজালেন খাদেম হোসেন; পরে কণ্ঠসংগীত, গাইলেন ইউসুফ খান কোরেশী ও ইয়াসিন খান। এ রকম শ্রোতার আসর হয়েছিল বেশ কয়েকটি। (সন্জীদা খাতুন, ছায়ানট/স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা, পৃষ্ঠা ১১)
এসো হে বৈশাখ, খুঁজে পাওয়া গেল বটমূল
ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের উদ্বোধন হয় ১৯৬৩ সালের পয়লা বৈশাখ। বাংলা একাডেমির তিনতলার একটি ঘর ছিল ছায়ানটের ক্লাসরুম। এরপর তা চলে আসে হেয়ার রোডের ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলের টিনশেডে (পরে এই স্কুলের নাম হয় উদয়ন), এরপর আজিমপুরের অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়, কলাবাগানের লেক সার্কাস বালিকা বিদ্যালয় হয়ে স্বাধীনতার পর নীলক্ষেতের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে। এখন তা শংকরে নিজস্ব ভবনে। (এস এম আহসান মুর্শেদ, ছায়ানট—একটি স্মৃতিচারণ/স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা, পৃষ্ঠা ৮১–৮২)
বিদ্যায়তনের বর্ষপূর্তি আর বার্ষিক পরীক্ষার পুরস্কার বিতরণের জন্য ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে কৃষ্ণচূড়াগাছের নিচে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে হতে পারেনি। ১৯৬৬ সালে আবার তা হলো। বিদ্যায়তনের বছর শেষের এ অনুষ্ঠানেই নববর্ষের কিছু গান করা হতো। তাতে বিরক্ত হলেন ছায়ানটের শুভানুধ্যায়ী জিয়াউল হক। তিনি এ অনুষ্ঠান আলাদাভাবে করতে বললেন এবং একটু বড় জায়গা নিয়ে করতে বললেন।
ড. নওয়াজেশ আহমদ তখন বাইরে থেকে দেশে ফিরেছেন। ওয়াহিদুল হক তাঁকে বললেন, ‘শোনেন, আপনি তো ছবি তুলবার নেশায় অনেক ঘুরে বেড়ান। নববর্ষের অনুষ্ঠানের উপযুক্ত একটা খোলা জায়গার খোঁজ দিন তো।’
নওয়াজেশ আহমদ বললেন, ‘চলেন, একদিন রমনা রেস্তোরাঁর দিকে যাই আপনাদের নিয়ে।’ রেস্তোরাঁর উত্তর–পশ্চিম পাশে বেশ বড় একটা গাছ। সে গাছের গোড়ায় বেদি বাঁধানো।
১৯৬৭ সাল থেকে এখানেই শুরু হলো নববর্ষের অনুষ্ঠান। বলা হয়, রমনা বটমূল। কিন্তু আসলে তা অশ্বত্থগাছ। গাছের নামকে ন্যায্যতা দিতে অভিধান ঘাঁটা হলো। দেখা হলো অশ্বত্থ, বট, বিল্ব আমলকী, অশোকের বন হলো পঞ্চবটী। পঞ্চবটের সমারোহে যদি অশ্বত্থ আর বট দুই–ই থাকে, তাহলে যা অশ্বত্থ, তা–ই তো বট। সুতরাং বটমূল বলায় আর কোনো সমস্যা থাকল না। প্রতিবছর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। (সন্জীদা খাতুন, ছায়ানটের পহেলা বৈশাখ/আলোকের ঝর্ণাতলায়, পৃষ্ঠা–১৪)।
এই মিলনমেলায় যুক্ত হয়েছে অনেকেই। রমনা বটমূলের পয়লা বৈশাখের প্রভাতি গানের আসরে হোসেনি দালানের দপ্তর থেকে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা মিছিল নিয়ে যায়। তাদের হাতে থাকে বর্ণিল কাগজে সজ্জিত আমের ডাল। প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদকে জোরদার করে তোলে। সেখানে ছায়ানটের শিক্ষার্থীদের থাকে বড় ভূমিকা। (মফিদুল হক, ছায়ানটের কাছে ঋণ/স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা, পৃষ্ঠা ৯১–৯২)
বড় বেদনার মতো
ছায়ানট সব সময় যে গান করে এসেছে, তা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে প্রতিরোধের গান। জানিয়ে রাখা দরকার, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই এক বছরই ছায়ানটের পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়নি। পঁচাত্তর–পরবর্তীকালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সরকারি রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বাদ সেধেছে। কখনো মাইক্রোফোন কাড়াকাড়ি করেছে, কখনো মঞ্চ ভাগাভাগি করে অনুষ্ঠান করতে বলেছে, কখনো বেনামি ফোন এসেছে মঞ্চের নিচে বোমা আছে বলে। এই সবকিছুই সামাল দিয়েছে ছায়ানট।
২০০১ সালে রমনার বটমূলে ঘটল বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা। তখন বাজছিল ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’ গানটি। সাতজন মানুষ মারা গেলেন ঘটনাস্থলেই, পরে মারা গেলেন আরও তিনজন। বিটিভিতে সরাসরি দেখানো হচ্ছিল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান ভন্ডুল হয়ে গেলে উপস্থাপক হাসান ইমাম মাইক্রোফোনে ঘটনার নিন্দা জানালেন। ছায়ানটের পক্ষ থেকে বলা হলো, এই সন্ত্রাস পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান উৎসব থেকে বাঙালিকে বিমুখ করতে পারবে না।
২০০২ সালের পয়লা বৈশাখে শোক ভুলে আবার রমনা বটমূলে জড়ো হয়েছিল সবাই। সে শোক বরং নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে চলার পথ তৈরি করে দিয়েছে। তাই পয়লা বৈশাখে ঢাকার মানুষ এখনো দিন শুরু করে ছায়ানটের ‘আলোকের এই ঝর্নাধারায়’ নিজেকে ‘ধুইয়ে’ দিয়ে এবং তারপর প্রত্যয়ী হয় ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’র সুরে সুরে। সে রসমধুধারায় সিক্ত হয়ে প্রথম দিনের সূর্য ওঠে এই মহানগরীতে। ‘এসো হে বৈশাখ’ যেন ‘বৎসরের আবর্জনা’ দূর করে নতুন প্রত্যাশা জাগায় মনে।
(লেখাটি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল বৈশাখ–এর ১৪২৬ বঙ্গাব্দ সংখ্যায়)