হিমোফিলিয়া রক্তের একটি বিশেষ রোগ। সাধারণত জিনগত বা জন্মগতভাবে মানুষ এই রোগ বহন করে। আমাদের শরীরে কোথাও কেটে গেলে, রক্তপাত হলে স্বাভাবিকভাবেই তা জমাট বাঁধে। রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। কিন্তু হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধতে সময় লাগে। অনেক সময় ধরে রক্তক্ষরণ চলতে থাকে। এর কারণ, রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ প্রোটিন ফ্যাক্টর। হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এ প্রোটিনের ঘাটতি থাকে।
যে কারণে হয়
সাধারণত ছেলেরা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হয়। আর মেয়েরা হিমোফিলিয়ার জন্য দায়ী জিন বহন করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে X-linked disease, যা মানুষের শরীরের এক্স ক্রোমোসোমের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় চলতে থাকে। তাই মা যদি তাঁর এক্স ক্রোমোসোমে এই জিন বহন করেন, তবে তাঁর ছেলেসন্তানেরা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। আর মেয়েসন্তানেরা এর বাহক হতে পারে। তাই পারিবারিক ইতিহাস জানা জরুরি। তবে ২৫ শতাংশের কোনো পারিবারিক ইতিহাস না–ও থাকতে পারে।
ধরন ও তীব্রতা
হিমোফিলিয়া সাধারণত দুই ধরনের। হিমোফিলিয়া–এ এর কারণ শরীরের প্রোটিন ফ্যাক্টর এইট–এর ঘাটতি। আর হিমোফিলিয়া–বি হয় ফ্যাক্টর নাইন–এর ঘাটতির জন্য। তবে রোগের তীব্রতা অনুযায়ী একে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
মৃদু: এদের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে কোথাও কেটে গেলে বা আঘাত পেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
মাঝারি: মাঝে মাঝে মাংসপেশি, হাড়ের সংযোগস্থল ও অন্যান্য টিস্যুতে রক্তক্ষরণ হয়।
মারাত্মক: এ ক্ষেত্রে আঘাত ছাড়াই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এ ছাড়া মাংসপেশি, হাড়ের সংযোগস্থল বিশেষত হাঁটু, কনুই, পায়ের গোড়ালি ফুলে যেতে পারে ও ব্যথা হয়। এমনকি ত্বকের নিচে ও মাড়িতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। শিশু অবস্থাতেই লক্ষণ প্রকাশ পায়।
চিকিৎসা পদ্ধতি
শুরুতেই শনাক্ত করা জরুরি। এ জন্য রোগীর যথাযথ পারিবারিক ইতিহাস ও লক্ষণ জানার পর রক্তের স্ক্রিনিং পরীক্ষা করাতে হয়। এরপর তাঁর এপিটিটি ও নির্দিষ্ট ফ্যাক্টরের মাত্রা নিরূপণ করে হিমোফিলিয়া নির্ধারণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এ পরীক্ষাগুলো করা যায়।
হিমোফিলিয়া যেহেতু বংশগত রোগ, তাই এটি থেকে কখনোই পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। জীবনভর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ থাকতে হয়। এই রোগের চিকিৎসা হলো নিয়মিত ফ্যাক্টর ইনজেকশন দেওয়া। শরীরে প্লাজমা পরিসঞ্চালন করা। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়। এর ফলে সৃষ্ট অন্যান্য শারীরিক অসুবিধাগুলোর আলাদা করে চিকিৎসা করাতে হয়।
হঠাৎ রক্তক্ষরণে করণীয়
হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির হঠাৎ রক্তক্ষরণ হলে বিশ্রাম নিতে হবে। প্রয়োজন হলে আক্রান্ত স্থান উঁচু করে রাখতে হবে। যেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেই জায়গা চেপে ধরে রাখতে হবে। সেই জায়গায় প্রয়োজনে বরফ কিংবা শীতল পানি দেওয়া যেতে পারে। বেশি ব্যথা হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ডা. মাফরুহা আক্তার, সহকারী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ