যেভাবে ফিট থাকেন আয়রনম্যান
একদিন আরাফাতকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাধারণভাবে দেখলে তো আপনাকে আয়রনম্যান মনে হয় না।’ কারণ, আয়রনম্যান শব্দটিতে একটি কাঠিন্য বিরাজ করে, পেশিবহুল শারীরিক কাঠামো ও শক্তিমত্তার কথাও মনে চলে আসে। উত্তরে আরাফাত বললেন, ‘আমি সেটা বোঝাতেও চাই না। আমাকে দেখে মানুষ আয়রনম্যান ভাবুক, সেটা চাই না।’
মোহাম্মদ শামছুজ্জামান আরাফাত না চাইলেও আয়রনম্যান। সাঁতার, সাইক্লিং আর দৌড় মিলিয়ে যে ক্রীড়া, সেটা ট্রায়াথলন। ট্রায়াথলনের কঠিনতম চ্যালেঞ্জ হলো আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা। এশিয়া, ইউরোপের কয়েকটি আয়োজনে আয়রনম্যান খেতাব পেয়ে গত সেপ্টেম্বরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০.৩ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে চ্যালেঞ্জ পূর্ণ করেন সফলভাবেই। প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর তথ্যচিত্র আয়রনম্যান আরাফাত তাঁকে নিয়ে।
আয়রনম্যান, তাই তাঁকে শারীরিকভাবে ফিট থাকতে হয় সব সময়। ‘আসলে সবার জন্যই ফিটনেস দরকার। আর তা সহজেই করা যায়।’ প্রশ্ন জাগতে পারে, আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জ জয় করার জন্য ফিটনেস ধরে রাখতে আরাফাত কি নিয়মিত জিম করেন? কঠিন ডায়েট করেন? ব্যায়ামের ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন?
এসব প্রশ্নের উত্তরই নেতিবাচক। আরাফাত বলেন, ‘আমি সব সময় নিজের শরীর ব্যবহার করে খালি হাতের ব্যায়াম (ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ) করি। খুব বেশি খাবার খাই না। পরিকল্পনা করে খাবার খাই, বিশেষ করে প্রতিযোগিতা বা ইভেন্টের সময়।’ বাংলা চ্যানেল সাঁতার, লম্বা দূরত্বের দৌড় কিংবা আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা—এসব ইভেন্টের আগে চার মাস ধরে প্রস্তুতি নেন আরাফাত। আর সারা বছরের প্রতিদিনই চলে তাঁর চর্চা। এই চর্চাও বেশ ক্যাজুয়ালি করেন আরাফাত।
পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চি উচ্চতার আরাফাতের ওজন ৬১ কেজি। একহারা ছিপছিপে গড়ন। গত বছরের নভেম্বরে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন বঙ্গোপসাগরে ১৬.১ কিলোমিটার দূরত্বের বাংলা চ্যানেল সাঁতারে পাশে নৌকা থেকে যখন দেখছিলাম, তখন বোঝা গেছে সাঁতারে তাঁর তীব্র গতি। মনে হচ্ছিল পিচ্ছিল কোনো মাছ গভীর সাগরের বড় বড় ঢেউ কেটে এগিয়ে চলছে।
আয়রনম্যানের ব্যায়াম
আরাফাত নিয়মিত ব্যায়াম করেন খালি হাতে।
আরাফাতের সাপ্তাহিক রুটিনটা এমন—
২ দিন খালি হাতে স্ট্রেংথ ট্রেনিং।
২ দিন কোর ওয়ার্কআউট। এই ব্যায়াম করেন পেট থেকে কোমর পর্যন্ত।
২ দিন হিট ট্রেনিং। হিটের পূর্ণ রূপ হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভ্যাল ট্রেনিং। এটি হলো পুরো শরীরে ব্যায়াম। ব্যায়ামের রুটিনে ১ দিন যোগব্যায়াম থাকে আরাফাতের।
১ দিন পুরো বিশ্রাম। আরাফাতের ভাষায় বিশ্রাম মানে সত্যিকারের বিশ্রাম।
এর বাইরে সপ্তাহে ৩ দিন সাঁতার কাটেন আরাফাত।
আরাফাত বললেন, ‘আমি যেহেতু ট্রায়াথলন করি, তাই সাঁতার, দৌড় আর সাইক্লিং চর্চা করি জীবনযাপনের অংশ হিসেবেই। কোনো ইভেন্টের আগে সপ্তাহে ৪ বার সাইক্লিং, ৫ বার দৌড় চর্চা করি।’ প্রতিযোগিতায় যে দূরত্ব পেরোতে হবে, সেই দূরত্বই থাকে চর্চায়।
কয়েক দিন আগে এক সন্ধ্যায় নিজের বাসা পলাশী থেকে আরাফাত এলেন কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো অফিসে। হালকা হাঁপাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে আরাফাত বললেন, ‘বিকালে দৌড়াচ্ছিলাম। ভাবলাম আবার পোশাক বদলে আসতে সময় লাগবে বেশি। আর রাস্তাতেও অনেক জ্যাম। তাই দৌড়ে এলাম।’ টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধা ১,০০৪ কিলোমিটার দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা যার, সেই আয়রনম্যানের জন্য এই দূরত্ব তো নস্যি!
আরাফাত বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক। অফিসে প্রতিদিন যাতায়াত করেন সাইকেলে। বললেন, ‘ঢাকায় মোটামুটি সাইকেলে যাই সব জায়গায়। শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জেও সাধারণত সাইকেলে যাওয়া হয়।’ আর করোনার সময় নোয়াখালীর নিজ বাড়িতেও ঢাকা থেকে সাইকেলে গিয়েছেন আরাফাত। আর সবকিছুর পরে সপ্তাহে এক দিন ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার সাইকেল চালান আরাফাত।
ট্রায়াথলনে তিনটি খেলার সমন্বয় ঘটে। আরাফাত যোগ করলেন, ‘ট্রায়াথলনের চতুর্থ অংশ হলো পুষ্টি। এটা আমি নিশ্চিত করি পরিকল্পনা ভিত্তি করে।’
আয়রনম্যান যা খান
ইভেন্টের সময় পরিকল্পনা করে খাই। প্রতিদিনের খাবার তালিকাও এমন থাকে। ভোর সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে যাই। সকালের নাশতার আগে আরাফাত একটু পানি, এক কাপ কালো কফি পান করেন। সঙ্গে থাকে বিস্কুট।
সকালের নাশতা বেশি করেই করেন। নাশতায় থাকে ডিম, রুটি, সবজি, একটু মিষ্টান্ন আর মৌসুমি ফল।
দুপুরের খাবার বাড়ি থেকে নিয়ে যান অফিসে। খাবারের সময় সাড়ে ১২টা। মেনুতে থাকে ১টা ডিম, সবজি-খিচুড়ি ও মাছ। মাছ বেশি খান আরাফাত। মাংস যে একেবারে খান না, তা নয়। গরু বা খাসির মাংস মাসে ২-৩ বার।
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে নাশতার তালিকায় থাকে কেক, কলা আর বাদাম।
রাতের খাবার নিয়ম করে সাড়ে সাতটার মধ্যে সারেন আরাফাত। মেনু দুপুরের মতোই।
বিছানায় যান ঠিক সাড়ে নয়টায়। দশটার মধ্যে ঘুম। এর আগে এক কাপ দুধ পান করে নেন আরাফাত।
প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ লিটার পানি পান করেন আরাফাত। মৌসুমি ফল ও মৌসুমি সবজি সব সময় থাকে আয়রনম্যানের খাবার তালিকায়।
চাইলেই সম্ভব
ফিট থাকা তো বটেই, চাইলে লম্বা দৌড়, সাইক্লিং, সাঁতার সবই সম্ভব সবার পক্ষে। আরাফাত শোনালেন সেই ফর্মুলা—‘ওয়াক-জগ-রান’। ধরুন প্রথম দিন ৩ মিনিট হাঁটলেন, ২ মিনিট জগিং আর ১ মিনিট দৌড়ালেন। এরপর ধীরে ধীরে সময়টা বাড়িয়ে নিলেন।
আরাফাত বললেন, ‘ধীরে ধীরে সময় বাড়ালে ২১ দিনেই ব্যায়াম বা শরীরচর্চাকে ভালো বেসে ফেলবেন।’ ২১ দিন কেন? ‘বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত টানা ২১ দিন কোনো কিছু করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। পুরোনো অভ্যাস বদলে যায়।’ বললেন আয়রনম্যান।
সবশেষে আরাফাত শোনালেন সেই চিরায়ত সত্য, শরীর ফিট রাখতে জীবনযাপনে শৃঙ্খলার বিকল্প নেই।