৩৫ বছর বয়সী ব্যাংকার শামীমা সুলতানার বেশ কিছুদিন ধরে একটু হাঁটলে, কাজ করলে কিংবা কখনো কখনো কিছু না করলেও বুক ধড়ফড় করে। কখনো আবার ঘুমের মধ্যেও এ সমস্যা হয় তাঁর। বুক ধড়ফড় করার কারণে ঘুম থেকে জেগে বসে থাকেন তিনি। সহকর্মীরা বিষয়টি শুনেই বলে দিলেন হৃদ্রোগে ভুগছেন শামীমা সুলতানা। এটি শুনে তিনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন।
২৪ বছর বয়সী ছাত্র রাসেল হোসেন ভুগছেন একই সমস্যায়। বিশেষ করে পরীক্ষার আগে সমস্যা যেন প্রকট আকার ধারণ করে। সমস্যাটি বন্ধুরা জানার পর একই মন্তব্য করেন যে তাঁর হয়তো হৃদ্রোগ আছে।
আসলেই কি ব্যাপারটি তাই? বুক ধড়ফড় করা মানেই কি হৃদ্রোগ?
অধিকাংশ সময়ই অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন, বুক ধড়ফড় করা শব্দগুলো শুনলেই প্রথম যে কারণটির কথা মাথায় আসে তা হচ্ছে হৃদ্রোগ। অবশ্য এটি হৃদ্যন্ত্রঘটিত সমস্যাই বটে। তবে বুক ধড়ফড় করা মানেই যে হৃদ্রোগ, তা–ও সব সময় ঠিক নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ সমস্যার নাম প্যালপিটেশন। সময়ে–অসময়ে হৃৎকম্পনের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যাওয়াকেই বলা হয় প্যালপিটেশন। সোজা বাংলায় কেউ একে বলে থাকেন বুক ধড়ফড়, কেউবা বলেন বুক ধুকপুক বা বুক লাফানো ইত্যাদি।
আসলে মানবদেহ এক অপার বিস্ময়। এর কর্মপ্রক্রিয়া, গতি-প্রকৃতির ধরন আরও বেশি বিস্ময়কর। দেহের প্রতিটি অঙ্গের কাজ সুনির্দিষ্ট। যথার্থ নিয়ম মেনে তারা তাদের কাজ করে চলে। একটু এদিক–ওদিক হলেই দেহ জটিলতার মুখে পড়ে। আমাদের হৃদ্যন্ত্রও ছন্দময় গতিতে স্পন্দিত হয় সারাক্ষণ। এই স্পন্দন আমরা টের পাই না। স্বাভাবিকভাবে টের পাওয়ারও কথা নয়। কিন্তু কেউ যদি স্পষ্টভাবে টের পায় তখন এটিকে প্যালপিটেশন বা বুক ধড়ফড় করছে বলা হয়।
নানা কারণেই এই বুক ধড়ফড় হতে পারে। তবে এটা ঠিক যে বুক ধড়ফড় করা অর্থাৎ হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হৃদ্রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, অন্য যেসব কারণে এ সমস্যা হতে পারে সেগুলো হলো থায়রয়েডের সমস্যা, ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে শর্করা কমে যাওয়া, রক্তশূন্যতা, শারীরিক দুর্বলতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, যেকোনো ধরনের ভয়, মদ্যপানের অভ্যাস, নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ এবং অনেক সময় অ্যামলোডিপিন, অ্যামিট্রিপটাইলিন, থাইরক্সিন ইত্যাদি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও বুক ধড়ফড় করে থাকে। ডায়াবেটিক রোগীর স্নায়ুগত জটিলতার কারণে হার্টের ভালভের সমস্যা, জন্মগত হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি শারীরিক সমস্যার কারণে বিশ্রামের সময় কিংবা ঘুমের ভেতরও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে।
হঠাৎ হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলে করণীয়
কারও যদি হঠাৎ হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, তবে প্রথমেই চেষ্টা করতে হবে তা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। এর জন্য নিচের কাজগুলো অনুসরণ করতে পারেন। যেমন:
• নাক–মুখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে থাকুন।
• শিথিলায়নের ধ্যান করতে পারেন।
• চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিতে পারেন।
• পানি খাবেন।
• আগে থেকে যদি লো প্রেশার বা রক্তস্বল্পতার সমস্যা থেকে থাকে, তবে স্যালাইন, শরবত, সেদ্ধ ডিম খেতে পারেন।
• মুখে আঙুল দিয়ে বমি করার চেষ্টা করবেন।
হঠাৎ হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া খুব সাধারণ একটি ঘটনা। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, পরিশ্রমসহ বিভিন্ন কারণে এটি হতে পারে। সাধারণত কিছুক্ষণের মধ্যেই কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই ঠিক হয়ে যায়। এতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু এই সমস্যা যদি কারও নিয়মিত হতে থাকে, বিশেষ করে বিশ্রামরত অবস্থাতেও যদি কারও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় বা বুক ধড়ফড় করে সে ক্ষেত্রে কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি। বুক ধড়ফড় করা বস্তুত কোনো রোগ নয়। বরং এটি অন্য রোগের উপসর্গ মাত্র। তাই নিয়মিত যদি কারও এ সমস্যা দেখা দেয়, তবে তার আগের রোগের ইতিহাসের পাশাপাশি বর্তমান শারীরিক অবস্থার ধরন ও প্রকৃতি জানা প্রয়োজন।
প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসক এগুলো দেখেই কিছুটা ধারণা করতে পারেন। তবে নিশ্চিত হতে ইসিজি, কয়েক ধরনের রক্ত পরীক্ষা, হল্টার মনিটরিং, ইকোকার্ডিওগ্রাফি করে থাকেন।
ওষুধ বা অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি যাপিত জীবনে কিছু বিষয় মেনে চলাও আবশ্যক। যেমন:
• অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন পরিহার করা।
• বিভিন্ন রকমের ইয়োগা, বায়োফিডব্যাক, অ্যারোমা থেরাপি, মিউজিক থেরাপি নেওয়া যেতে পারে।
• মেডিটেশনের অভ্যাস করতে পারেন।
• ধূমপান, মদ্যপান, যেকোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার করতে হবে।
• অতিরিক্ত কফি, চা বা পান বর্জন করতে হবে।
• চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যেকোনো ধরনের ওষুধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
অনেক সময় হঠাৎ হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার ফলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন। এ রকম হলে সময় নষ্ট না করে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে। আর যাঁদের আগে থেকেই হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ আছে বা পরিবারে হৃদ্রোগের ফলে মৃত্যুর ইতিহাস আছে, তাঁদের জন্য বুক ধড়ফড় করা একটি সতর্কবাণী। তাই বুক ধড়ফড় করলে অবহেলা করা উচিত নয়। দ্রুত একজন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো উচিত এবং কারণ খুঁজে সঠিক চিকিত্সা করা উচিত।
লেখক: ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা