অতিরিক্ত চিনি খেয়ে বিষণ্নতায় ভোগার ঝুঁকি কার বেশি, নারী নাকি পুরুষের?

আসছে ঈদুল ফিতর। মিষ্টিজাতীয় খাবারে ভরপুর থাকবে টেবিল। তাই ঈদ আসার আগে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করুন। আপনি কি মিষ্টিপ্রেমী? রোজ মিষ্টিজাতীয় খাবার না হলে মনমেজাজ খারাপ হয়? উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে বুঝতে হবে, আপনি চিনিতে আসক্ত। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার প্রবণতা হতাশা, বিষণ্নতাসহ মানসিক আরও নানা সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। তৈরি করতে পারে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যাও। আর এসবে কারা বেশি ভোগেন—নারী নাকি পুরুষ?

প্রাকৃতিকভাবেই ফল, সবজি ও শস্যের মতো জটিল শর্করায় চিনি থাকে। আবার পাস্তা, কেক, বেক করা খাবার, রুটি, কোমলপানীয় ও ক্যান্ডির মতো প্রক্রিয়াজাত খাবারেও চিনি থাকে অতিরিক্ত। তাই কোন খাবার কতটুকু খাবেন, সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ। হতাশা বা বিষণ্নতার সঙ্গে চিনির সম্পর্ক কী, কীভাবে অভ্যাসে পরিবর্তন আনবেন, জেনে নিন।

চিনির সঙ্গে হতাশার সম্পর্ক

লন্ডনের গবেষকেরা দেখেছেন, ফল, সবজি ও মাছের মতো খাবার মধ্যবয়সে হতাশার ঝুঁকি কমাতে পারে। এ গবেষণা অনুসারে, যেসব মানুষ মিষ্টি ডেজার্ট, ভাজা খাবার ও প্রক্রিয়াজাত মাংসের মতো খাবার বেশি খেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে হতাশায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে যাঁরা মূলত প্রাকৃতিক খাবারের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের হতাশায় ভোগার প্রবণতা তুলনামূলক কম। তাই হতাশা দূরে রাখতে প্রাকৃতিক খাবার সেরা।

চিনির নেশা কোকেনের চেয়েও বেশি

ইঁদুরের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের মিষ্টি গ্রহণকারী অংশ প্রতিনিয়ত উচ্চমাত্রার চিনি গ্রহণের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। চিনি এতই শক্তিশালী যে শুধু স্বাভাবিক মানুষ নয়, মাদকাসক্ত ব্যক্তির কাছে কোকেনের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, অর্থাৎ চিনির প্রতি আসক্তি কোকেনের চেয়েও শক্তিশালী। এমনকি আপনার শরীরের কলকবজাগুলো এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। পানীয় থেকে সস, চকলেট থেকে স্যান্ডউইচ—কোথায় নেই চিনি! এই নেশা থেকে বেরিয়ে আসবেন কীভাবে? প্রতিদিনের খাবার থেকে ধীরে ধীরে চিনি কমান। ধীরে ধীরে চিনির পরিমাণ কমালে আপনার রসনা বা জিব তা মানিয়ে নেবে।

যাঁরা অতিমাত্রায় বেক করা খাবার খেয়েছেন, তাঁদের হতাশায় ভোগার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি
ছবি: পেক্সেলস

চিনি, প্রদাহ, হতাশা

প্রাকৃতিক ফল ও সবজি দিয়ে সাজানো ডায়েট শরীরের প্রদাহ কমাতে পারে। অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত চিনিযুক্ত খাবার প্রদাহ বাড়ায়। আর দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের সঙ্গে যোগসূত্র আছে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার। বিপাকীয় সমস্যা, ক্যানসার ও হাঁপানি এসবের মধ্যে অন্যতম। গবেষণামতে, হতাশার সঙ্গেও প্রদাহের সম্পর্ক থাকতে পারে। প্রদাহ ও হতাশার অনেক লক্ষণে মিল আছে। যেমন খাবারের প্রতি অনীহা, স্বাভাবিক ঘুমের সময়ে পরিবর্তন, অতিরিক্ত ব্যথা অনুভব করা ইত্যাদি।

বেক করা খাবারও দায়ী

মাফিন, পেস্ট্রি এবং অন্যান্য বাণিজ্যিকভাবে তৈরি বেক করা খাবারগুলো বেশ মজার নিঃসন্দেহে। কিন্তু এসব মুখরোচক খাবারই হতাশা টেনে আনতে পারে। স্পেনের এক গবেষণা বলছে, যাঁরা অতিমাত্রায় বেক করা খাবার খেয়েছেন, তাঁদের হতাশায় ভোগার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি। এই গবেষকদের মতে, খাদ্যের ট্রান্স ফ্যাট এখানে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ধরনের অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট থেকেই প্রদাহ শুরু হয় এবং হৃদ্‌রোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। বাজারের বেক করা খাবারেও এই ফ্যাট থাকে।

আরও পড়ুন

পুরুষের ঝুঁকি বেশি

অতিরিক্ত চিনি খেলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা নারীর চেয়ে পুরুষের ওপরই বেশি
ছবি: পেক্সেলস

অতিরিক্ত চিনি খেলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা নারীর চেয়ে পুরুষের ওপরই বেশি। গবেষণামতে, যেসব পুরুষ দিনে ৬৭ গ্রাম বা তার বেশি চিনি খেয়েছেন, পাঁচ বছর পর তাঁদের হতাশায় ভোগার হার ২৩ শতাংশ বেশি ছিল। ৪০ গ্রাম বা তার চেয়ে কম চিনি খেয়েছেন, এমন পুরুষদের বিষণ্নতার ঝুঁকি কম ছিল। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শ হলো, দিনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ২৫ গ্রাম ও পুরুষের ৩৬ গ্রামের বেশি চিনি খাওয়া উচিত নয়। তবে ৮২ শতাংশেরও বেশি মার্কিন এই দৈনিক মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। কারণ, চিনি সহজলভ্য। চারপাশে তাকালে দেখবেন, অতিরিক্ত যোগ করা চিনিযুক্ত খাবারের রমরমা। ফলে জেনে বা না জেনে, চিনি খাওয়া হয়ে যায় খুবই সহজে। তাই খাবার খাওয়ার আগে প্যাকেট, ক্যান বা বোতলের গায়ের লেবেল সতর্কতার সঙ্গে পড়ুন।

আরও পড়ুন

চিনিকে ‘না’ বলার উপায়

যেমন পানীয় খাবেন

কোমলপানীয়, সোডা, এনার্জি ড্রিংক ও কফির মতো পানীয়তে প্রচুর চিনি থাকে। রেস্তোরাঁর বিভিন্ন স্মুদি, জুস বা ফলের জুসেও অতিরিক্ত চিনি দেওয়া হয়। এসবের পরিবর্তে সাধারণ পানি বা চিনি ছাড়া চা খেতে পারেন। প্রাকৃতিক মিষ্টতার স্বাদ পেতে লেবুর রস মেশাতে পারেন।

স্বাস্থ্যকর ডেজার্ট খান

দুগ্ধজাত ডেজার্ট বা মিষ্টান্নতে থাকে চিনি ও সরল শর্করা। দুপুর বা রাতের খাবারের পরে এসব ভারী কিন্তু কম পুষ্টিগুণের খাবার এড়িয়ে চলতে পারেন। এর বদলে তাজা ফলমূল, খেজুর বা এক টুকরা ডার্ক চকলেট খাওয়া যেতে পারে।

ভালো শর্করার উৎস

সব শর্করা বা চিনি খারাপ নয়। শর্করার মানও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই শর্করার জন্য হোল গ্রেইন বা গোটা দানার শস্য খাওয়া উত্তম। সাদা ময়দা, সাদা পাস্তা কিংবা সাদা ভাতের বদলে গোটা দানার শস্যে রুটি, ভাত বা পাস্তা খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। সরবরাহ হয় অতিরিক্ত পুষ্টি। প্রক্রিয়াজাত খাবারে এটা পাওয়া যায় না।

খাবার থেকে চিনি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বেশ কাজে দেয়
ছবি: পেক্সেলস

ফুড লেবেল পড়ুন

খাবার প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো মজাদার সস, টিনজাত স্যুপ ও পাউরুটির মতো খাবারের স্বাদ আরও বাড়াতে অতিরিক্ত চিনি যোগ করে। তাই কেনার আগে প্যাকেট বা বয়ামের ‘ফুড লেবেল’ বা খাদ্য উপকরণের তালিকায় চোখ বোলান। যদি প্রথম পাঁচটি উপাদানের মধ্যে অতিরিক্ত চিনি খুঁজে পান, তাহলে পণ্যটি না কেনাই ভালো।

চ্যালেঞ্জ করুন নিজেকে

অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিন। প্রয়োজনে পরিবার, বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গেও চিনি না খাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন। খাবারে ব্যবহার করা অতিরিক্ত চিনি ও কৃত্রিম চিনি আপনার ডায়েট থেকে দুই সপ্তাহের জন্য সরিয়ে ফেলুন। দেখবেন, খাবারে নতুন নতুন স্বাদ আবিষ্কার করতে পারবেন। কিছু সপ্তাহ আগেও চিনির প্রতি যে বাড়াবাড়ি রকমের ভালো লাগা কাজ করত, তা কমে গেছে।

সূত্র: হেলথলাইন

আরও পড়ুন