‘শিশুর জন্মগত ত্রুটি এড়াতে নারীর খাদ্যে দরকার ফলিক অ্যাসিড’
সন্তান নিতে চান বা মাত্রই গর্ভধারণ করেছেন, এমন নারীর জন্য দরকার ফলিক অ্যাসিড। নারীদের নিয়মিত খাবার, বিশেষ করে চাল, গম, ভোজ্যতেল ও লবণে ফলিক অ্যাসিড যুক্ত করা দরকার। এতে গর্ভের সন্তানের জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি দূর হবে।
আজ সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বিশ্ব স্পাইনা বিফিডা এবং হাইড্রোসেফালাস দিবস ২০২৪’ উপলক্ষে ‘ব্রিজিং দ্য গ্যাপস’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে এ কথা উঠে আসে। জাতিসংঘের পুষ্টি উন্নয়ন সংস্থা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন) এই সভার আয়োজন করে।
আলোচনায় বলা হয়, গর্ভবতী নারীদের শরীরে ফলিক অ্যাসিডের অভাবে জন্ম নেয় শারীরিক ত্রুটিযুক্ত শিশু। তাই গর্ভধারণের পরপরই চিকিৎসকেরা আলাদাভাবে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করতে বলেন। বিশেষ করে শুরুর দিনগুলোতে; যখন গর্ভের শিশুর মস্তিষ্ক, মাথার হাড় ও মেরুদণ্ড গঠিত হয়। গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ না করলে গর্ভের শিশুর মাথা এবং মেরুদণ্ডের পূর্ণ বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। শিশু জন্মগতভাবে আক্রান্ত হয় ‘নিউরাল টিউব ডিফেক্ট’ নামক স্নায়বিক রোগে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে স্পাইনা বিফিডা এবং হাইড্রোসেফালাস। চিকিৎসকেরা বলেন, আক্রান্ত রোগীকে আমৃত্যু এ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয়। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে ফলিক অ্যাসিড। শুধু গর্ভাবস্থায় নয়, প্রজননক্ষম সব নারীকেই সচেতনভাবে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করতে হবে। সেটা আলাদাভাবে সম্পূরক হিসেবে হোক অথবা নিয়মিত খাদ্যতালিকার খাবারের সঙ্গে।
সভায় সূচনা বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব (জনস্বাস্থ্য অধিশাখা) মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে অনুন্নত, স্বল্প উন্নত উন্নয়নশীল দেশের কোটি কোটি নারী ফলিক অ্যাসিডের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত নন। ফলে তাঁদের অনাগত গর্ভের শিশুরা ঝুঁকিতে আছে। এ বছর বিশ্বে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার শিশু জন্ম নিয়েছে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে।
শিব্বির আহমেদ ওসমানী আরও বলেন, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১২ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশে এ ধরনের শিশুর হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু ২০১৯-২০২০–এর জরিপে এটি বেড়ে হয়েছে ২০ শতাংশের বেশি। এটি রোধে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে ফলিক অ্যাসিড যুক্ত করা শুরু করতে হবে। প্রজননক্ষম নারীদের শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি পূরণ করতে পারলেই শিশুর জন্মগত ত্রুটি এড়ানো সম্ভব।
সভার মূল বক্তব্যে পুরো বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এবং হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জারি) সুদীপ্ত কুমার মুখাজি৴। শারীরিক ত্রুটি নিয়ে শিশুর জন্মের কারণ, ধরন এবং এর পরিণাম সম্পর্কে তিনি বলেন, নিউরাল টিউবের ত্রুটি শিশুর শরীরে অনেকগুলো রোগের সমন্বয় ঘটায়। মস্তিষ্কের পূর্ণ গঠন হয় না, মাথায় পানি জমে, পা সরু হয়ে যাওয়া ছাড়াও নানান রোগ দেখা দেয়। ফলে আক্রান্ত শিশু এবং তাঁর পরিবার ভয়াবহ কষ্টে থাকেন।
সুদীপ্ত কুমার মুখার্জি আরও বলেন, ‘চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার করে শিশুকে বাঁচানো গেলেও রোগ সম্পূর্ণ সারানো যায় না। গুরুতর হলে অনেক শিশু গর্ভাবস্থায়ই মারা যায়। বিভিন্ন উন্নত দেশ স্বাভাবিক খাদ্যে ফলিক অ্যাসিড যুক্ত করে এই রোগ নির্মূল করতে পেরেছে। আমাদেরও সেই পথে হাঁটতে হবে। নির্দিষ্ট বয়সের প্রজননক্ষম নারীদের এই ফলিক অ্যাসিডের গুরুত্ব বোঝাতে হবে। মা–বাবার নখে বা চুলে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার শিকার হলেও শিশু শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। তাই এ ব্যাপারেও আমাদের সচেতনভাবে ভাবতে হবে। আমরা লবণে আয়োডিনযুক্ত করে গলগন্ড রোগ নির্মূল করতে পেরেছি। যথাযথ আলোচনার মাধ্যমে আমরা শিশুদের এই নিউরাল টিউব ত্রুটিও দূর করতে চাই।’
লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন বিভাগের (এলএসএফএফ) প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, ফুড ফর্টিফিকেশন বা খাদ্যে মিশ্রণ একটি বড় কাজ। পুরো দেশের মানুষ যেন স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল, খনিজ ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে পায়, সেটি নিশ্চিত করতে এটি করা হয়। চাল, তেল, আটা, ময়দা, দুধ এসবে নানা পুষ্টি উপাদান যুক্ত করা হয়। স্থানবিশেষে মানুষের শরীরের ঘাটতি বুঝে খাবারে পুষ্টি উপাদান মেশানো হয়। শিশুর জন্মগত ত্রুটি রোধে প্রজননক্ষম নারীদের শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি পূরণ করতে এটি করতে পারি।
আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন ইফাদ ও মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তারা। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ) যুগ্ম সচিব মো. আনোওয়ার হোসেন আকন্দ বলেন, ‘খাদ্যের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ মেশানো আসলে ব্যবসার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন সুস্থ এবং পূর্ণভাবে গড়ে উঠতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ফলিক অ্যাসিড খাবারে যুক্ত করতে হবে।’
মুক্ত আলোচনায় দেশের নারীদের শুধু গর্ভাবস্থায়ই নয়, আগে থেকেই ফলিক অ্যাসিড খাওয়ার জন্য সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেন সভায় উপস্থিত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক সারোয়ার ইবনে সালেম বলেন, বাংলাদেশে বছরে ৩০ লাখ শিশু জন্ম নেয়। এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার শিশু জন্মায় নিউরাল টিউবের ত্রুটি নিয়ে। এই শিশুদের মধ্যে প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছাতে পারে মাত্র ৭৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ) যুগ্ম সচিব মো. আনোওয়ার হোসেন আকন্দ বলেন, নীতিনির্ধারকদের এই বিষয়ে সচেতন করতে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সভায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের (বিএনএনসি) ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এবং হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মো. জয়নুল ইসলাম।