চোখ শুষ্ক হয়ে যায়? কী করবেন?

চোখ জ্বালাপোড়া, চোখ খচখচ, চোখ লাল, চোখে চুলকানি ও চোখে হালকা পিঁচুটি জমা হওয়া ড্রাই আই বা শুষ্ক চোখের লক্ষণ
ছবি: পেক্সেলস

‘ড্রাই আই’ কথাটা আজকাল খুব বেশি শোনা যায়। চোখে জ্বালাপোড়া, খচখচ, লাল ভাব, চুলকানি ও হালকা পিঁচুটি জমা হওয়া ড্রাই আই বা শুষ্ক চোখের লক্ষণ। কেন দেখা দেয় এসব লক্ষণ? প্রতিকারের উপায়ই–বা কী?

আমাদের চোখে অনেক গ্রন্থি আছে। চোখকে নিরাপদ রাখাই এগুলোর কাজ। কোনো কারণে গ্রন্থির মুখ বন্ধ হয়ে গেলে বা গ্রন্থিগুলো থেকে পানি নিঃসরণ কমে গেলে চোখ শুষ্ক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চোখের পানি তৈরির ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। চোখের পানির ঘনত্বেও আসে পরিবর্তন। সাধারণত নারীরা, বিশেষ করে মেনোপজের পর এ সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন। কারণ, কিছু হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে তখন চোখের পানি তৈরির ক্ষমতা হ্রাস পায়।

কীভাবে বুঝবেন

চোখ জ্বালাপোড়া, চোখ খচখচ, চোখ লাল, চোখে চুলকানি ও চোখে হালকা পিঁচুটি জমা হওয়া ড্রাই আই বা শুষ্ক চোখের লক্ষণ। এ সময় চোখে একধরনের অস্বস্তি বোধ হয়। আমাদের ধারণা, পিঁচুটি মানেই হলো চোখ ওঠা। বা চোখ চুলকানো মানেই অ্যালার্জি। আসলে তা না–ও হতে পারে। প্রায়ই দেখা যায়, চুলকানির প্রধান কারণ এই চোখের শুষ্ক ভাব। বিশেষ করে যাঁরা কম্পিউটারে বা ডিজিটাল স্ক্রিনে দীর্ঘ সময় কাটান।  

কেন হয় ‘ড্রাই আই’?

চোখের শুষ্কতা দুইভাবে হতে পারে। হয় চোখের পানি বা টিয়ারের উৎপাদন কমে গিয়ে। অথবা টিয়ারের বাষ্পীভূত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে। চোখের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, বয়সজনিত এবং হরমোনের প্রভাবে টিয়ারের উৎপাদন কমে যায়।

চোখের পানি বাষ্পীভূত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায় মেবোমিয়ান গ্রন্থির নিঃসরণ কমে গেলে। গবলেট সেল বা কনজাংটিভার গ্রন্থির নিঃসরণ কমে গেলে, চোখের পলক ফেলার হার কমে গেলে (সাধারণত ডিজিটাল স্ক্রিনে কাজের সময় এটি হয়) বা বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকলেও এমন হয়।

কীভাবে শনাক্ত করবেন?

শারমার টেস্ট নামে পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে পারবেন আপনি চোখের শুষ্কতায় ভুগছেন কি না। এই টেস্টে একধরনের ফিল্টার পেপার ব্যবহার করা হয়, যা দৈর্ঘ্যে ৩৫ মিলিমিটার ও প্রস্থে ৫ মিলিমিটার। একে বলা হয় শারমার স্ট্রিপ। এই স্ট্রিপের মাথার দিকের নির্ধারিত অংশ ভাঁজ করে চোখের নিচের পাতার ভেতরে ঢুকিয়ে ৫ মিনিট চোখ বন্ধ রাখতে হয়। তারপর বের করে ভেজা অংশ কত মিলিমিটার, দেখা হয়। ১০ মিলিলিটার বা তার বেশি হলে চোখের পানির পরিমাণ স্বাভাবিক। আর এর কম হলে চোখের পানির ঘাটতি আছে ধরে নিতে হবে। এ ছাড়া এনজাইম অ্যানালাইসিস নামে আরেকটি পরীক্ষা আছে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক সময় চোখের পানি বা টিয়ারে বিদ্যমান এনজাইম লাইসোজাইম ও ল্যাকটোফেরিন ইত্যাদির মাত্রা পরীক্ষা করে ড্রাই আই শনাক্ত করা হয়।

চিকিৎসা কী

শুষ্কতার মাত্রাভেদে বিভিন্ন টিয়ার প্রিপারেশন বিভিন্ন ডোজে ব্যবহার করতে হয়।


১. চোখ স্বল্প মাত্রায় শুষ্ক হলে কৃত্রিম চোখের পানি, অর্থাৎ পলিইথিলিন গ্লাইকল ও প্রোপাইলিন গ্লাইকলের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।
২. মাঝারি তীব্রতার শুষ্ক হলে ১ ভাগ কার্বোক্সিমিথাইল সেলুলোজ বা সিএমসি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।
৩. তীব্র মাত্রার হলে ১ ভাগ হিপ্রোমেলোজ বা অন্যান্য প্রিপারেশন ব্যবহার করতে পারেন।
তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওষুধ ব্যবহার করা ঠিক নয়। অবশ্যই একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। কৃত্রিম চোখের পানির সুনির্দিষ্ট কোনো ডোজ নেই। দিনে যে কয়েকবার দিলে চোখে আরাম বোধ হয়, সেটাই ডোজ।

প্রতিকার

১. হালকা ও আরামদায়ক গরম ভাপ চোখের ভেতরের অংশের সঞ্চালন বৃদ্ধি করে অশ্রু উৎপাদন ত্বরান্বিত করে। একই সঙ্গে গরম ভাপ আইলিড গ্ল্যান্ডের তেল নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি করে। হালকা গরম পানিতে নরম পরিষ্কার তোয়ালে চুবিয়ে পানি নিংড়ে ভাঁজ করে চোখের পাতার ওপর দিয়ে রাখতে হবে কয়েক মিনিট। প্রতিদিন দুইবার এভাবে গরম ভাপ নিলে তিন-চার দিনের মধ্যে চোখের শুষ্কতার সমস্যা কমবে।

২. চোখের পাতা ভালোভাবে পরিষ্কার করার মাধ্যমেও চোখের শুষ্কতা কমানো যায়। চোখের পাতা পরিষ্কার করতে ক্ষারমুক্ত বেবি শ্যাম্পু হাতের আঙুলে নিয়ে ঘষে ফেনা তৈরি করতে হবে। এবারে চোখ বন্ধ করে চোখের ওপরের পাতা বরাবর ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করতে হবে। ম্যাসাজের পুরো সময়টুকু চোখ বন্ধ রাখতে হবে। এবার হালকা গরম পানিতে চোখের পাতা ধুয়ে নিতে হবে। প্রতিদিন রাতে একবার এভাবে চোখ পরিষ্কার করলে সমস্যা কমবে।

৩.ক্যাফেইন টিয়ার গ্ল্যান্ডের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে। যাঁদের ইনসমনিয়ার সমস্যা ও ক্যাফেইন সেনসিটিভিটি নেই, তাঁরা ক্যাফেইন (চা বা কফি) গ্রহণ করতে পারেন। দৈহিক ওজনের ওপর নির্ভর করে ২ থেকে ৬ কাপ পর্যন্ত কফি পান করতে পারবেন, যা চোখের শুষ্কতা কমাতে পারবে।

৪. প্রবল বাতাস ও আলোযুক্ত স্থানে সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে। মোটরসাইকেল চালানোর সময় গগলস পরতে হবে। শুষ্ক চোখের সমস্যা নিয়ে যদি স্ক্রিন ওয়ার্ক করতে হয়, অর্থাৎ কম্পিউটার ও মুঠোফোন ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়, তবে গ্লাস পরে কাজ করতে পারেন। সানগ্লাস আলোকে স্তিমিত করে চোখে পৌঁছায়, এতে চোখের ওপর চাপ কম পড়ে এবং চোখের শুষ্কতাও হয় বিলম্বিত।

৫. যাঁরা দীর্ঘ সময় স্ক্রিন ব্যবহার করেন, তাঁরা বারবার বিরতি নেবেন। দৃষ্টি সরিয়ে নেবেন এবং চোখের পলক ফেলবেন। কম্পিউটারের লেভেলও যেন এমন উচ্চতায় থাকে, যাতে চোখ বড় বড় করে বা উঁচিয়ে দেখতে না হয়।

৬. ধূমপান চোখের শুষ্কতার ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান বর্জন করুন।

৭. হেয়ার ড্রায়ার, টেবিল ফ্যান, হিটার বা এসির বাতাস যেন সরাসরি চোখের ওপর এসে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখুন। যাঁরা সব সময় হিটার বা এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহার করেন, তাঁরা হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করবেন।  

৮. শুষ্ক চোখের পেছনে থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, লুপাস, সোগ্রেন সিনড্রোম, রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস, ভিটামিন এ—এর অভাব ইত্যাদি রোগ লুকিয়ে থাকতে পারে। প্রয়োজনে এর চিকিৎসা করতে হবে। কিছু ওষুধ, যেমন অ্যান্টিহিস্টামিন, ডিকনজেসটেন্ট, হরমোন থেরাপি, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, পারকিনসন রোগের ওষুধ—ড্রাই আইয়ের জন্য দায়ী হতে পারে।  

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ এ কে আজাদ, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, চক্ষু বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।