বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যেভাবে আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে

এই সময় পানিশূন্যতা, পেশিতে ব্যথা থেকে শুরু করে হিট স্ট্রোকে মৃত্যুও ঘটে।
ছবি: সংগৃহীত

কয়েক দশক ধরেই পরিবেশবিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে আসছেন। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্বিচার গাছ কাটা, যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া, বাড়িঘর ও অফিসে এসির ব্যবহার গ্রিনহাউস গ্যাস যেমন কার্বন ডাই–অক্সাইড, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইডকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য যেমন গলছে হিমবাহ, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ফলে সমুদ্রতীরে দেশগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ সব সময়ই দুর্যোগপ্রবণ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দুর্যোগের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র তাপদাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, বজ্রপাত, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য যেমন প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও পড়ছে পৃথিবীর মানুষ, যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে আরও বেশি।

আসুন, এ সম্পর্কে আমরা জেনে নিই।

জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের শরীরে দুইভাবে প্রভাব ফেলে—

  • পুরোনো রোগগুলোতে ঘন ঘন ও মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়া

  • নতুন নতুন রোগ দেখা দেওয়া

ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যেমন অ্যাজমা, সিওপিডির তীব্রতা বাড়ছে
ছবি: সংগৃহীত

তাপপ্রবাহজনিত প্রভাব

আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তীব্র তাপপ্রবাহ চলে। বর্তমানে এই তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময় পানিশূন্যতা, পেশিতে ব্যথা থেকে শুরু করে হিট স্ট্রোকে মৃত্যুও ঘটে। তাপদাহ থেকে রক্ষা পেতে দরকার ছাড়া বাইরে বের না হওয়া, বের হলে ছাতা ব্যবহার করা, বেশি বেশি তরল পান করা, অজ্ঞান হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ¯হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

দূষিত বাতাসের প্রভাব

আমরা সবাই জানি, ঢাকার বাতাসে এখন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বাতাসে মিশে আছে সিসা, দস্তা, সালফার, সিএফসিসহ মারাত্মক ক্ষতিকর সব পদার্থ। এরা ফুসফুসের শ্বাসনালিতে ক্ষত তৈরি করছে, বায়ুথলি বা এলভিওলিগুলো আমাদের ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যেমন অ্যাজমা, সিওপিডির তীব্রতা বাড়ছে, হাসপাতালে ভর্তিও বেড়ে যাচ্ছে।

প্রাণিবাহিত রোগ

মশা, পাখি ও অন্যান্য প্রাণিবাহিত রোগ বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াগুলো সুপ্ত অবস্থায় ছিল, তাদের অনেকেই তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে সক্রিয় হয়ে যাচ্ছে, রোগও ছড়াচ্ছে। যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাইম ডিজিজ, ওয়েস্ট নেইল ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে।

পাহাড়ি ঢল, অতিবর্ষণের কারণে পানিবাহিত রোগের মাত্রাও বাড়ছে।
ছবি : প্রথম আলো

পানিবাহিত রোগ

পাহাড়ি ঢল, অতিবর্ষণ ও ঝড়ের কারণে স্বাদুপানির উৎস দূষিত হচ্ছে। ফলে পানিবাহিত রোগ, যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মাত্রাও বাড়ছে।

মানসিক সমস্যা

মানুষের শারীরিক যেকোনো সমস্যা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ মনের ওপর চাপ ফেলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের মনকে অস্থির করে; উদ্বেগ, হতাশা অনেক বেড়ে যায়। সহায় সম্পত্তি বা প্রিয়জন হারানোর আশঙ্কাও চলে আসে।

খাদ্যনিরাপত্তা

অতিবন্যা, খরা ও উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা আমাদের ফসলের জমি ও ফসল নষ্ট করে। যার পরিণতি খাদ্যঘাটতি ও অপুষ্টি। এ ছাড়া কৃষিকাজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে তা খাবারে মিশে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের মনকে অস্থির করে
ছবি: প্রথম আলো

কারা বেশি ঝুঁকিতে

  • ছোট শিশু ও বয়স্করা

  • গর্ভবতী মায়েরা

  • যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে, যেমন অ্যাজমা, সিওপিডি, ডায়াবেটিস

  • যাদের দীর্ঘ সময় বাইরে কাজ করতে হয়, যেমন শ্রমিক, কৃষক, রিকশাচালক, ট্রাফিক পুলিশ।

তাপমাত্রা কমাতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ৩৬০ ডিগ্রি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অ্যালায়েন্সের মতো সংস্থাগুলো সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে আমাদের জ্বালানির ব্যবহার কমানো, বৃক্ষনিধন বন্ধ ও অধিক সবুজায়নে মনোযোগী হতে হবে।

ডা. আফলাতুন আকতার জাহান, মেডিসিন স্পেশালিস্ট, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা