শ্বাসকষ্ট মানেই কি অ্যাজমা?
শীত এলেই যেমন আবহাওয়ার ধরন পাল্টায়, তেমনি রোগবালাইও নতুনভাবে আবির্ভূত হয়। শুষ্ক–শীতল বাতাসের সঙ্গে হাজির হয় সর্দি, কাশি, হাঁচি, শ্বাসকষ্টের মতো অসুবিধা। সারা বছর আরামসে চলেফিরে বেড়ানো লোকজন আচমকা শ্বাসের কষ্ট নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ঠান্ডায় শ্বাসকষ্ট মানেই বেশির ভাগ মানুষই ধরে নেন যে অ্যাজমার কারণেই এই সমস্যা। অ্যাজমাজনিত শ্বাসকষ্ট শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় বেড়ে যায়, এটা সত্যি; তবে শ্বাসকষ্টের আসলে শতেক কারণ রয়েছে, যা আমরা বেশির ভাগ সময়ই ধর্তব্যের মধ্যে আনি না।
আমাদের শরীরে বুকের দুই পাশে এক জোড়া ফুসফুস রয়েছে, যাদের কাজ হচ্ছে বাতাসের অক্সিজেন নিয়ে রক্তকে পরিশুদ্ধ করা। তাই ফুসফুসের যেকোনো সমস্যায় মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে পারে। অ্যালার্জিজনিত রোগ অ্যাজমা বা হাঁপানি শীতের শ্বাসকষ্টের একটা অন্যতম প্রধান কারণ হলেও ফুসফুসের আরও অনেক রোগ আছে, যা থেকে রোগী শ্বাসকষ্ট নিয়ে উপস্থিত হয়। হাঁপানির মতোই ব্রঙ্কাইটিস বা এমফাইসেমা রয়েছে (একসঙ্গে যাদের সিওপিডি বলা হয়), যাতে রোগী সারা বছর শ্বাসকষ্টে ভোগে, তবে শীতে তা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। এ ছাড়া ফুসফুসে যক্ষ্মা, ক্যানসার বা নিউমোনিয়া হলে কিংবা ফুসফুসে যেকোনো কারণে পানি, রক্ত বা বাতাস জমা হলে, এসব রোগে শ্বাসকষ্টই মূল সমস্যা হিসেবে থাকে।
দুই ফুসফুসের মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে বসে থাকা হৃদ্যন্ত্রটির নানান রোগেও শ্বাসকষ্টই কখনো কখনো প্রধান সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশেষ করে হার্ট ফেইলিউরে (হৃৎপিণ্ডের বৈকল্য) শ্বাসকষ্টের কারণেই রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে থাকে ধীরে ধীরে। এ ছাড়া হৃদ্যন্ত্রের জন্মগত ত্রুটি, হৃদ্যন্ত্রে রক্ত সঞ্চালনে বাধা বা হৃদ্যন্ত্রের চারপাশে পানি জমলেও মৃদু, মাঝারি বা তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
ফুসফুস বা হৃৎপিণ্ডের সমস্যা ছাড়াও আছে আরও অনেক কারণ। শরীরে রক্তস্বল্পতা হলে অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া ইত্যাদি সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়। অতি স্থূল মানুষের অল্প হাঁটাচলাতেই শ্বাসকষ্ট হয়। থাইরয়েড হরমোনের অভাবে শ্বাসকষ্টের অভিযোগ জানান অনেক রোগী। এমনকি কখনো কখনো অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হতে পারে অনেকেরই।
তবে যে কারণেই হোক না কেন, শ্বাসকষ্টের কারণ নির্ণয় করা খুব জরুরি। কারণ বের করে সঠিক চিকিৎসা না হলে শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বেড়ে তা যেমন রোগীর অসহনীয় শারীরিক কষ্টের কারণ হয়, আবার সময়মতো চিকিৎসা দেওয়া না হলে তা জটিল আকার ধারণ করতে পারে। অ্যাজমার কারণে শ্বাসকষ্ট হলে রোগী বছরের কিছু কিছু সময় শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন; সঙ্গে কাশি, কফ এবং শ্বাসযন্ত্র থেকে বাঁশির মতো আওয়াজ হওয়ার মতো সমস্যা থাকতে পারে, সেই সঙ্গে অ্যালার্জির ইতিহাসও থাকে। সিওপিডি রোগী সাধারণত ধূমপায়ী হন এবং সারা বছরই শ্বাসকষ্ট, কাশি ইত্যাদির ইতিহাস থাকে। এভাবে রোগীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে, সেই সঙ্গে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শ্বাসকষ্টের সঠিক কারণ নির্ণয় করে সময়োচিত চিকিৎসা প্রদান করা জরুরি। তবে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে শীত এলে ঠান্ডা, ধুলাবালু এড়িয়ে চলা। যেকোনো মৌসুমেই ধূমপান পরিহার করা। ঠান্ডা বা ধুলাবালুতে অ্যালার্জি থাকলে তার চিকিৎসা নেওয়া।
শীত আসুক নলেন গুড়ের সুবাস নিয়ে, রঙিন সবজির সতেজতা নিয়ে, হাপরের মতো বুকের ওঠানামা নিয়ে নয়। শ্বাসকষ্ট হলে ভয় না পেয়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে মুক্তি পেতে পারবেন অহেতুক জটিলতা থেকে।
*ডা. শাহনূর শারমিন: সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা