অ্যাড্রিনালিন রাশের সময় গুরুতর জখমেও কেন ব্যথা লাগে না
১৯৯৮ সালের কথা। রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছিলাম। মোড় ঘুরতেই সামনে পড়ল দ্রুতবেগে ছুটে আসা একটি মোটরবাইক। মনে হলো সবকিছু যেন থমকে গেছে। খুব ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে সময়। চারদিকের শব্দ, কোলাহল—সবকিছু থেমে গেছে। আমার সামনে তখন দুটি বিকল্প—ডানে বা বাঁয়ে সাইকেলের মুখ ঘোরালে বাইকের সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা খাবে আমার পা বা শরীর। অন্যদিকে সাইকেলের হাতল সোজা রাখতে পারলে বাইকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম মুখোমুখি সংঘর্ষেই যাব। সাইকেলের হাতল সোজা করে শক্ত করে ধরে অপেক্ষায় রইলাম। মনে হলো বাইকটা আস্তে আস্তে আমার সাইকেলে বাড়ি খেল। আর আমি ধীরে ধীরে শূন্যে ভাসলাম। বাইকের ওপর দিয়ে ভেসে রাস্তার ওপর পড়লাম। এরপর আস্তে আস্তে চারদিকের কোলাহল ফিরে এল। বাইকার তাঁর বাইকটি রাস্তার পাশে রেখে আমাকে মাটি থেকে তুললেন। আমার প্যান্টের দুই হাঁটুর ওপরের অংশ কেটে রক্ত বেরোচ্ছিল। অবাক করা ব্যাপার হলো, কোনো ধরনের ব্যথার অনুভূতি আমার হয়নি।
একটা রিকশা ভাড়া করে ভাঙা সাইকেল নিয়ে বাসায় চলে এলাম। ক্ষত পরিষ্কার করলাম। দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা পর ব্যথার অনুভূতি ফিরে এল। এই ব্যথার অনুভূতি ফিরে আসার স্বাভাবিক অবস্থার আগের সময়টাই ছিল অ্যাড্রিনালিন রাশ।
মানুষ যখন অনেক বড় বিপদের মুখোমুখি হয়, তখন শরীর থেকে দ্রুত নিঃসৃত হয় অ্যাড্রিনালিন। বিপদের সময় জীবন বাঁচাতে ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই হরমোন। আমাদের দেহের ফিজিওলজি বা শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ দুটি অবস্থার মধ্যে অদলবদল হতে থাকে। এর একটা হলো ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স মানে লড়ো নয়তো পালাও প্রতিক্রিয়া। আরেকটা হলো রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট রেসপন্স বা বিশ্রাম ও হজম প্রক্রিয়া।
উৎপত্তি
যেকোনো বিপৎসংকেত প্রথমে মস্তিষ্কে গ্রহণ করে। সেখান থেকে নিউরোট্রান্সমিটার নরঅ্যাড্রিনালিন নিঃসৃত হয়। সেটি আমাদের কিডনির ওপর অবস্থিত অ্যাড্রিনাল গ্লান্ডে গিয়ে অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণ করে। এই হরমোন সাময়িকভাবে ইনসুলিন তৈরি বন্ধ করে দেয়, যাতে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ড সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।
শরীরে অ্যাড্রিনালিন হরমোনের প্রভাব
সাধারণত বিপদের সময় আমাদের দেহে অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসৃত হয়ে জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে। এ সময় যেসব পরিবর্তন হয়, তা হলো রক্ত আমাদের শরীরের অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় অংশ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয় অংশগুলোতে বেশি পরিমাণে প্রবাহিত হয়।
যার ফলে চোখের তারা বড় হয়ে যায়, যাতে বেশি আলো প্রবেশ করতে পারে, এতে আমরা ভালোভাবে সবকিছু দেখতে পারি। এ ছাড়া হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে ব্রেনে ও মাংসপেশিতে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়।
অন্যদিকে চামড়া থেকে রক্ত সরে যায় ও অনুভূতি কমে যায়। যার ফলে কেটে গেলে অল্প রক্তপাত হয় ও ব্যথা কম অনুভূত হয়।
এ ছাড়া শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় ও অনেক ঘাম নিঃসৃত হয়।
দৈনন্দিন জীবনে অ্যাড্রিনালিনের ভূমিকা
প্রাত্যহিক জীবনে কেউ স্ট্রেস বা মানসিক চাপে থাকলেও অ্যাড্রিনালিন রাশ অল্প পরিমাণে নিয়মিত ঘটতে পারে।
রাতে বেশি সময় উজ্জ্বল আলোতে কাজ করলে অ্যাড্রিনালিন নিঃসরণ হয়। এ ছাড়া নানা রকম মানসিক দুশ্চিন্তা বা ভয় অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণে ভূমিকা রাখে।
এ জন্য ঘুমের এক ঘণ্টা আগে থেকে টিভি বা মোবাইল ব্যবহার করা বা উজ্জ্বল আলোতে কোনো কাজ করা উচিত নয়। এতে অ্যাড্রিনালিন নিঃসরণ বাড়ে।
সত্যিকারের বিপদ ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় অ্যাড্রিনালিন নিঃসরণ হলে তা শরীরের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হয়। এ সময় শ্বাসপ্রশ্বাসের হার ও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। শরীরে ঘাম হয়। মাথায় রক্ত চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া খাবার হজমে সমস্যা দেখা যায়।
অ্যাড্রিনালিন হলো একটা পজিটিভ ফিডব্যাক হরমোন। সাধারণত কোনো হরমোন নিঃসরণ হলে তা একটি মাত্রায় এলে শরীর তার বিপরীতে আরেকটি হরমোন নিঃসরণ করে। কিন্তু অ্যাড্রিনালিন বিপৎকালীন হরমোন দেখে এটির মাত্রা শরীরে যত বাড়ে, তা তত বেশি পরিমাণে নিঃসরণ হয়। এর কোনো বিপরীত হরমোন নেই। তাই শরীর থেকে সম্পূর্ণ বের না হওয়া পর্যন্ত এই হরমোন কাজ করতে থাকে।
ফলে দেখা যায়, যাঁরা দুশ্চিন্তা করেন, তাঁদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়তে থাকে। মাইগ্রেনের ব্যথাও বাড়তে থাকে। অ্যাড্রিনালিন ইনসুলিন হরমোনকে অকার্যকর করে দেয়, ফলে রক্তে গ্লুকোজ অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বেড়ে যায়। হজম প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ না করায় শরীরে মেদ জমতে থাকে। যা পরবর্তী সময়ে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া নিদ্রাহীনতাও বৃদ্ধি পায়।
প্রতিরোধের উপায়
ঘুমানোর নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে এর ঘণ্টাখানেক আগে থেকে মুঠোফোন বা টিভি দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। উজ্জ্বল আলো ও উচ্চমাত্রার শব্দ থেকে দূরে থাকতে হবে।
অকারণ দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত ধ্যান ও হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে। রাতে চা–কফি বা কোনো উত্তেজক পানীয় না খাওয়াই উত্তম।
তাহলে এর ক্ষতিকর দিক থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে।