নিউরোসার্জারির বই ঠেলে সরিয়ে সন্তান বলেছিল, ‘মা, আমাকে পড়ো’
সারা দিনের কাজ সেরে আজিমপুর কলোনিতে নিজের বাসায় ফিরে এক কলেজশিক্ষিকা অবাক। ঘরভরা কুকুর! ব্যাপারখানা কী? স্কুলপড়ুয়া কন্যা তাঁকে জানাল, কুকুর নিধনের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে লোক পাঠানো হয়েছিল। তাই সে ওদের লুকিয়ে রেখেছে।
বৃষ্টির দিনে ক্লাসের পর পথে জমে থাকা পানি পেরিয়ে বাসায় ফেরার পথে এই কুকুরেরাই ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে তাকে নিয়ে যেত। পানির নিচে তো পথের খেই মেলা ভার। পানির ওপর দেখা যেত কেবল কুকুরদের মাথা আর লেজ। তাদের অবস্থান দেখেই মেয়েটি টের পেত, কোন দিকটায় গেলে গর্তে পড়তে হবে না।
মেয়েটির নাম রেজিনা হামিদ, বড় হয়ে এই মেয়েই হয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম নারী নিউরোসার্জন। শৈশবেই তাঁর মধ্যে গড়ে ওঠে ব্যথিত প্রাণের জন্য নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়ার মানসিকতা। মানবিক মনটাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন। সাফল্যের জোয়ারে হারিয়ে যেতে দেননি অন্তরের সৌন্দর্য।
চিকিৎসক হয়ে ওঠা
নিউরোসার্জন শুনেই হয়তো ভাবছেন, শৈশবে ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ে তাঁর ক্লাস-রোল ত্রিশের আশপাশেই ঘোরাফেরা করত! বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের দিনগুলোতেও নজরকাড়া সাফল্য নেই। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় প্রথম মেধাতালিকায় জায়গা করে নেন। সার্জারি অথবা গাইনি, ইন্টার্নশিপের সময় একটি বেছে নিতে বলা হলে মাত্র দুজন নারী সার্জারিতে আগ্রহী দেখিয়েছিলেন। তাঁদের একজন রেজিনা।
ইন্টার্নশিপ শেষে সিকদার মেডিকেল কলেজ এবং বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে বিয়ে, দুই সন্তান। ৩৭ সদস্যের যৌথ পরিবার। স্বামী, শাশুড়ি, জা আর ননদেরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। রেজিনার মনে হতো, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো সন্তান ধারণ, সেটাই নারীরা করে। নারীর পক্ষে কিছুই তাই অসম্ভব নয়। সেই ভাবনা থেকেই নিউরোসার্জারিতে এমএস কোর্সে ঢোকার পরীক্ষা দিলেন। সুযোগও পেলেন।
বাসায় বালিশের ওপর বই রেখে পড়তেন রেজিনা। তাঁর ছোট্ট মেয়ে একদিন মোটাসোটা নিউরোসার্জারির বই ঠেলে সরিয়ে বালিশে শুয়ে পড়ে বলেছিল, ‘আমাকে পড়ো।’ কী তার আফসোস! মা যে শুধু বই পড়ে, ওকে পড়ে না!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষ সহপাঠীরা তাঁর এই ‘অনধিকারচর্চা’কে ইতিবাচকভাবে নেননি। তবে অধ্যাপক রাশিদুদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আফজাল হোসেন, অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক কনককান্তি বড়ুয়ার মতো শিক্ষকদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেন। বলা বাহুল্য, এমন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে কঠোর অধ্যবসায় আবশ্যক। বাসায় বালিশের ওপর বই রেখে পড়তেন রেজিনা। তাঁর ছোট্ট মেয়ে একদিন মোটাসোটা নিউরোসার্জারির বই ঠেলে সরিয়ে বালিশে শুয়ে পড়ে বলেছিল, ‘আমাকে পড়ো।’ কী তার আফসোস! মা যে শুধু বই পড়ে, ওকে পড়ে না!
নিজের পথে, নিজের কাজে
এমএস কোর্সে যখন সুযোগ পেলেন, সে সময় বিসিএসও হয়ে গেল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চাকরিও শুরু করলেন। ২০০৬ সালে এমএস শেষে বাধল বিপত্তি। পদায়ন হলো উপজেলায়, যেখানে নিউরোসার্জারির সুযোগই নেই। ভেবে দেখলেন, চর্চা না থাকলে নিউরোসার্জারির দক্ষতাটা নষ্ট হয়ে যাবে। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেন। ২০০৭ সালে যোগ দিলেন পুরোনো কাজের জায়গা বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে। এখন সেখানকার অধ্যাপক ও নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান।
প্রথম দিকে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীও দেখেছেন। কিন্তু তাঁর মা বলতেন, অর্থের পেছনে না ছুটে মন দিয়ে হাসপাতালে কাজ করাই ভালো। মায়ের সেই ভাবনাকেই জীবনের ব্রত করলেন রেজিনা। চেম্বার বাদ। প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলাদেশ হাইড্রোসেফালাস ও স্পাইনা বিফিডা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। হাইড্রোসেফালাস বা জলমাথা হলো পানি জমে মাথা বড় হয়ে যাওয়ার রোগ। আর স্পাইনা বিফিডা হলো মেরুদণ্ডের জন্মগত ত্রুটি। এমএস করার পর উগান্ডায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেনজামিন ওয়ার্ফের অধীন হাইড্রোসেফালাস নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রেজিনা হামিদ।
‘সফল’ বলতে রাজি নন
নিউরোসার্জারির রোগীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অস্ত্রোপচার করতে হয়। একেকটি অস্ত্রোপচারে সময়ও লাগে অনেক। যেকোনো রোগীকেই নিজের আপনজন ভেবে নেন তিনি। তাই নিজেই যখন নিজের মা আর শাশুড়ির মাথায় অস্ত্রোপচার করেছেন, তখনো আলাদা কিছু মনে হয়নি।
তবে বারবার বলছিলেন ফলিক অ্যাসিড ফরটিফিকেশন–বিষয়ক আফসোসের কথা। সে আবার কী? বুঝিয়ে বললেন সহজ ভাষায়, ‘গর্ভধারণের চার মাস আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ শুরু করলে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বহুলাংশে কমানো যায়। তাই সবাই গ্রহণ করেন—এমন খাবারে ফলিক অ্যাসিড যুক্ত করা বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চুক্তিপত্রে বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষরও করেছে। রেজিনা বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর মেয়ে ও অটিজম-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ অচিরেই খাবারের ফলিক অ্যাসিড ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ফরটিফিকেশন চালু করবেন।
রেজিনা হামিদ নিজেকে ‘সফল’ বলতে রাজি নন। তিনি বলেন, মানুষের মূল্যায়ন মানবিকতায়, পেশাগত পরিচয়ে নয়। বরং যাঁরা বহু প্রতিকূলতার মুখে সংগ্রাম করে টিকে থাকেন, তাঁরাই সফল।