কিশোর বয়সে অসংক্রামক রোগ কেন বাড়ছে

প্রায় ৩৭ শতাংশ দেশেই কিশোরদের একটা বড় সংখ্যা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ছবি: প্রথম আলো

মোটাদাগে আমাদের রোগগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—সংক্রামক ও অসংক্রামক। জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যেসব রোগ হয় এবং একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ে, সেসবকে বলে সংক্রামক রোগ। জীবাণু ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে রোগ হলে এবং যেসব রোগ একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না, সেসবকে বলে অসংক্রামক রোগ। এসব রোগের জন্য জেনেটিক ও পরিবেশগত কিছু কারণ দায়ী থাকে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার ইত্যাদি। আগে আমাদের দেশে সংক্রামক রোগের হার অনেক বেশি ছিল। টিকাদান কর্মসূচির কারণে বর্তমানে সংক্রামক রোগ অনেক কমে গেছে। কিন্তু অন্যদিকে অসংক্রামক রোগের হার বেড়ে গেছে। এসব অসংক্রামক রোগ বর্তমান বিশ্বে মানুষের মৃত্যু ও অক্ষমতার প্রধান কারণ (বিশ্বে ৭০ শতাংশ ও বাংলাদেশে ৬৭ শতাংশ) হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে বিশ্বে অসংক্রামক রোগের কারণে ৪২ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

২০২২ সালে দ্য ল্যানসেট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৪০টি দেশে ১১-১৭ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যে অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করা হয়। কিশোর বয়সে অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির জন্য অপর্যাপ্ত ফল ও শাকসবজি গ্রহণ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, এনার্জি ড্রিংকস, ফাস্ট ফুড ও কার্বোনেটেড কোমল পানীয় গ্রহণ, ধূমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত মেদ, স্থূলতা ইত্যাদি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। কিশোর বয়সে এসব রিস্ক ফ্যাক্টর গত ২০০৩-১৭ সালের মধ্যে প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৩৭ শতাংশ দেশেই কিশোরদের অর্ধেকের মধ্যে ৪টি বা তার বেশি অসংক্রামক রোগ সৃষ্টিকারী এসব রিস্ক ফ্যাক্টর বিদ্যমান এবং এই হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি।

কিশোর বয়সে অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির প্রধান ৩টি কারণ, যা প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি কিশোরের মধ্যে চিহ্নিত করা গেছে, তা হচ্ছে অপর্যাপ্ত ফল গ্রহণ, অপর্যাপ্ত শাকসবজি গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব। কিশোর বয়সের এসব অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও আচরণ অনেক পরিণত বয়সের রোগীর অসংক্রামক রোগের কারণ হিসেবেও চিহ্নিত।

আরও পড়ুন

২০১৯ সালে বিশ্বে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে প্রায় ৮ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ অন্যান্য জটিলতা তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসজনিত মৃত্যুর হার পুরুষের (৫০ দশমিক ৯৭ শতাংশ) তুলনায় নারীর (৫৩ দশমিক ৭২ শতাংশ) মধ্যে বেশি দেখা গেছে।

আধুনিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে কিশোর স্থূলতা একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। আগে মানুষ বাড়িতেই ফল, পিঠা, শস্যদানাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে নাশতা সারত। কিন্তু এখন সেসবের বদলে রেস্তোরাঁ বা বাইরে চিকেন ফ্রাই, গ্রিল, স্যুপ, উচ্চ চিনিযুক্ত কোমল পানীয়সহ ক্ষতিকর প্রক্রিয়াজাত খাবার খাচ্ছে। এসব খাবারে অতিরিক্ত লবণ, চর্বি ও চিনির ব্যবহার হয়, যার ফলে হৃদ্‌রোগসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগ তৈরি হচ্ছে।

কিশোর বয়সে সারাদিন অলস না থেকে খেলাধুলা ও শারীরিক কসরত করা উচিত
ছবি: প্রথম আলো

এ ছাড়া কিশোরদের মধ্যে ধূমপান ও মদ্যপানের হারও বেড়ে গেছে। এতে কিশোর বয়সেই অতিরিক্ত মেদ ও স্থূলতা তৈরি হচ্ছে, যা পরিণত বয়সের অকালমৃত্যু, স্থূলতা ও অন্যান্য রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অধিক সময় অলস কার্যক্রম, যেমন টিভি দেখা, ভিডিও গেমস খেলা, কম্পিউটার ও স্মার্টফোন ব্যবহার ইত্যাদির কারণেও কিশোর বয়সে মেদ ও স্থূলতা বাড়ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণের ফলেও কিশোরেরা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

করণীয় কী

আজকের শিশু-কিশোরেরাই জাতির আগামী দিনের সম্পদ। ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ঘোষিত সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় সব দেশের কিশোর ও তরুণেরাই সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশে কিশোরদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনেসকো স্কুলভিত্তিক স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে, যেখানে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও শারীরিক কসরতের জন্য মাঠ রাখতে হবে এবং পুষ্টিকর সুষম খাবার গ্রহণের জন্য উৎসাহ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

কিশোর বয়সে অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ফাস্ট ফুড
ছবি: পেক্সেলস

এক গবেষণা বলছে, স্কুলভিত্তিক স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রমের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শাকসবজি খাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং শারীরিক অলসতা, মানসিক অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধ করা যায়। এ ছাড়া উচ্চ চিনি, চর্বি ও লবণযুক্ত খাবার ও পানীয় কেনাবেচার ওপর সরকারের কঠোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। বিশেষ করে এসব চিনি ও লবণযুক্ত পানীয়র ওপর অধিক করারোপ ও মূল্য বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের মধ্যে এসব পণ্যের ব্যবহার কমানো যায় বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপরও জরুরিভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন, প্রভাষক, ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

আরও পড়ুন