আপনার শিশু কি বয়সের তুলনায় খাটো

সব মা-বাবাই চান, তাঁদের সন্তান লম্বা হয়ে বেড়ে উঠুক। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায়, শিশু বড় হচ্ছে বটে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় লম্বা হচ্ছে না। কেন এমন হয়?

শিশু যদি তার বয়সের তুলনায় গ্রোথ চার্ট অনুযায়ী খাটো থাকে, তাহলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে
ছবি : কবির হোসেন

শিশু খর্ব বা বয়সের তুলনায় খাটো কি না, প্রথমে বুঝতে হবে। এ জন্য সমবয়সী শিশুদের তুলনায় কম বাড়ছে কি না, লক্ষ করুন। শিশুর সঠিক বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে প্রথম বছর থেকে প্রতিবার টিকা দেওয়ার সময় (৬ মাস বয়সে একবার, ১ থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ৬ মাস পরপর) দৈহিক পরীক্ষা ও পরিমাপ করা উচিত। এরপর বছরে একবার এই কাজ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে জন্মের পর প্রথম ৩ বছর এবং পরবর্তী সময়ে বয়োসন্ধিকালে শিশুরা দ্রুত লম্বা হয়। এভাবে মেয়েরা ১৫ আর ছেলেরা ১৭ বছর বয়সে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতা লাভ করে। মাঝের সময়টুকুতে শিশু গড়ে বছরে ২ ইঞ্চি লম্বা হয়। এর ব্যতিক্রম হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

শুরুতেই চিকিৎসক শিশুর উচ্চতা পরিমাপ করে একটি নির্দিষ্ট গ্রোথ চার্টের সঙ্গে যাচাই করে শিশু প্রকৃতই খাটো কি না, তা নিরূপণ করবেন। যদি শিশু তার বয়সের তুলনায় গ্রোথ চার্ট অনুযায়ী সত্যিই খাটো হয়ে থাকে, তাহলে তার কারণ অনুসন্ধান করা উচিত।

আরও পড়ুন
২৩ থেকে ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুর খর্বতার কারণ তার পারিবারিক উচ্চতা
ছবি : কবির হোসেন

শিশুর খর্বতার কারণ মূলত দুটি—ফিজিক্যাল বা শরীরবৃত্তীয় ও প্যাথলজিক্যাল বা রোগগত। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে খর্বতার কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। কারণগুলো জেনে নিই—

পারিবারিক কারণে খর্বতা

২৩ থেকে ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুর খর্বতার কারণ তার পারিবারিক উচ্চতা। এসব শিশুর উচ্চতা স্বীকৃত গ্রোথ চার্টের নিচে অবস্থান করে, কিন্তু মা-বাবার উচ্চতা অনুযায়ী স্বাভাবিক থাকে। তারা সাধারণত অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত থাকে না, নির্দিষ্ট গতিতে বাড়তে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত পারিবারিক উচ্চতা সীমার মধ্যেই অবস্থান করে ।পারিবারিক কারণে খর্ব শিশুর লম্বা হওয়ার উপায় নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের গ্রোথ হরমোন দিয়ে খুব আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া গ্রোথ হরমোন অনেক ব্যয়বহুলও। তবে যাদের জেনেটিক স্টাডির ফল খুব নেতিবাচক নয়, বংশে ধারাবাহিকভাবে সবাই অতি মাত্রায় খাটো নয়, পরীক্ষা করে যাদের শরীরে আংশিক গ্রোথ হরমোনের অভাব বা আইজিএফ-১ হরমোনের অভাব পাওয়া যায়, তাদের ক্ষেত্রে গ্রোথ হরমোন চিকিৎসা ফলদায়ক হতে পারে। এ ছাড়া যেহেতু কারণ জানা যায়নি, এমন খর্ব শিশুর (ইডিওপ্যাথিক শর্ট স্টাচার) চিকিৎসায় গ্রোথ হরমোন থেরাপি অনুমোদিত, সে ক্ষেত্রে কিছু কিছু পারিবারিক কারণে খর্ব শিশুকে এই আওতায় এনে চিকিৎসার নজির রয়েছে। তবে এই সবকিছু বিবেচনার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সিদ্ধান্তই শেষ কথা।

বয়স অনুসারে শিশুর জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে হবে।
ছবি: কবির হোসেন

অপুষ্টিজনিত খর্বতা

আমাদের দেশে শিশুর খর্বতার একটি অন্যতম কারণ অপুষ্টি। দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্য, জন্মকালীন ওজন, বাসস্থান, টিকা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উচ্চতার তুলনায় এসব শিশুর ওজন কম থাকে। প্রতিকারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি ও অন্যান্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির কারণে খর্বতা

এটিও একটি শরীরবৃত্তীয় কারণ। এসব শিশু জন্মের প্রথম এক থেকে দুই বছর স্বাভাবিক উচ্চতা নিয়ে বাড়ে, এরপর স্বীকৃত গ্রোথ চার্টের সামান্য নিচে অবস্থান করে। তারা সাধারণত অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত থাকে না, নির্দিষ্ট গতিতে বাড়তে থাকে, বয়ঃসন্ধিকালে অন্য শিশুদের তুলনায় খানিকটা পিছিয়ে পড়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক উচ্চতা লাভ করে। তাদের বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হয় বিধায় এমন হয় এবং পরিবারে এই ধরনের ইতিহাস থাকতে পারে। এই সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য চিকিৎসক শিশুর ও পরিবারের গ্রোথ চার্ট মেনটেইন করবেন, অন্য কারণ বা বয়ঃসন্ধিজনিত কোনো রোগ আছে কি না, জানার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষে সঠিক রোগ নির্ণয় করবেন। যেহেতু এটিও একটি শরীরবৃত্তীয় সমস্যা, তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসা লাগে না। যদিও এসব শিশু একটু বিলম্বে তাদের কাঙ্ক্ষিত উচ্চতা লাভ করে, তবু এই স্বাভাবিক উচ্চতা পেতে অবশ্যই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওষুধের মাধ্যমে বয়ঃসন্ধি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে হতে পারে এবং খুব কমসংখ্যক ক্ষেত্রে স্থায়ী বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও লাগতে পারে।

শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির জন্য তাঁদের মানসিকভাবে ভালো রাখাটাও জরুরি । মডেল: রাইসা ও জ্যোতি।
ছবি: খালেদ সরকার

স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মানো শিশু

এসব শিশু অনেক কারণে মাতৃগর্ভে থাকতে ঠিকমতো বাড়ে না, তার মধ্যে রয়েছে মায়ের অপুষ্টি ও অসুস্থতা, আবার শিশুর সমস্যা। যেসব শিশু কোনো জটিল বা জন্মগত রোগে আক্রান্ত না হয়েও কম ওজন ও দৈর্ঘ্য নিয়ে জন্মায়, তার একটি বড় অংশ জন্ম-পরবর্তী সেবা ও চিকিৎসায় দুই বছরের মধ্যে স্বাভাবিক উচ্চতা ফিরে পায়। বাকি ১০ থেকে ১৫ ভাগ, যারা ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতা লাভ করতে পারে না, গ্রোথ হরমোন থেরাপির মাধ্যমে তাদের উচ্চতা বৃদ্ধির চিকিৎসা আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত।

জিনগত সিনড্রোম ও বিপাকের ত্রুটি

ডাউন সিনড্রোম, টার্নার সিনড্রোম, নুনান সিনড্রোম, কুশিং সিনড্রোম, প্রাডার-উলি সিনড্রোম, রাসেল-সিলভার সিনড্রোম ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত শিশুদের উচ্চতা কম হয়। এর মধ্যে টার্নার সিনড্রোম, নুনান সিনড্রোম ও প্রাডার-উলি সিনড্রোমের ক্ষেত্রে গ্রোথ হরমোন থেরাপি আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত। বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের বিপাক প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকলে, যেমন মিউকোপলিস্যাকারয়ডোসিসসহ কিছু রোগের কারণে শিশু খাটো হয়। সেই নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসা করলে কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে।

জন্মগত রোগে আক্রান্ত না হয়েও কম ওজন ও দৈর্ঘ্য নিয়ে শিশু জন্মালে, চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক উচ্চতায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব
ছবি : সংগৃহীত

মানসিক অসুস্থতার জন্য খর্বতা

শিশুদের মানসিক অসুস্থতা অনেক সময় আমরা উপেক্ষা করি। কিন্তু এই মানসিক অসুস্থতার কারণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, এর মধ্যে খর্বতাও রয়েছে। মানসিক অসুস্থতায় গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ কমে বিপরীতমুখী হরমোন বেড়ে যায় এবং ক্যালরি গ্রহণ কমে যায়, ফলে শিশু স্বাভাবিক উচ্চতা পায় না। তাই শিশুর শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

ওষুধ সেবনের কারণে খর্বতা

যেসব ওষুধ বর্ধনশীল হাড়ের ওপর কাজ করে, তাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োগ শিশুর খর্বতার কারণ হতে পারে, এর মধ্যে স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ এবং ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি অন্যতম। এসব ওষুধ ব্যবহারের সময় শিশুর পর্যাপ্ত বৃদ্ধির বিষয়ে যথাযথ নজর দিতে হবে।

ডা. রবি বিশ্বাস, শিশু হরমোন রোগবিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল

আরও পড়ুন