বাতজ্বর থেকে হতে পারে হৃদ্‌রোগ

বাতজ্বর মূলত শিশুদের অসুখ
ছবি: সংগৃহীত

আর দশটা জীবাণু সংক্রমণজনিত প্রদাহের মতো নয় বাতজ্বর। এতে প্রথমে গলায় একধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়। কয়েক সপ্তাহ পর শরীরে যে ব্যাকটেরিয়াপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা হৃদ্‌যন্ত্র ও শরীরের বড় অস্থিসন্ধির নানা উপাদানের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে প্রদাহের সৃষ্টি করে। ফলে দেহের এ অঙ্গগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 কারা ঝুঁকিপূর্ণ

বাতজ্বর মূলত শিশুদের অসুখ। সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের বাতজ্বর হয়ে থাকে। ৪ বছরের নিচে বা ২০ বছরের পর বাতজ্বর খুবই কম হয়। জনবহুল, অস্বাস্থ্যকর, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে বাতজ্বর বেশি হয়। বাতজ্বর একবার হলে বারবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বাতজ্বর কি ছোঁয়াচে

বাতজ্বর ছোঁয়াচে রোগ নয়। বাতজ্বরের রোগীর সঙ্গে থাকলে, খেলে, ঘুমালে বা ঘনিষ্ঠভাবে থাকলেও একজন থেকে আরেকজনের এ রোগ ছড়ায় না।

উপসর্গ

জ্বর, অস্থিসন্ধির ব্যথা ও ফুলে যাওয়া বাতজ্বরের প্রধান উপসর্গ। তবে রোগীর গলাব্যথার ইতিহাস, কিছু উপসর্গ ও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাতজ্বর নির্ণয় করা হয়। এ নির্ণয় বা ডায়াগনসিসের জন্য চিকিৎসকেরা নির্দিষ্ট মানদণ্ড ব্যবহার করেন।

প্রধান উপসর্গ

  • হৃৎপিণ্ডে প্রদাহের কারণে জ্বর, বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড়, নাড়ির গতি বেড়ে যাওয়া ও শ্বাসকষ্ট।

  • শরীরের বড় বড় সন্ধিতে প্রদাহ ও ব্যথা। কখনো একটি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাওয়ার পর অন্যটি আক্রান্ত হয়।

  • বুকে ও পিঠে লাল বর্ণের চাকা।

  • হাত-পা বা শরীরের কোনো অংশের নিয়ন্ত্রণহীন কাঁপুনি।

  • ত্বকের নিচে ছোট ছোট শক্ত ও ব্যথাযুক্ত দানা।

বাতজ্বর শনাক্ত করে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে না পারলে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি হার্টের সমস্যা

বাতজ্বর প্রতিরোধ

৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা উচিত। যেমন খাবারের পর দাঁত-মুখ ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। রাতে শোবার আগে ও সকালে ঘুম থেকে উঠে ভালোভাবে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। গলায় সংক্রমণ বা গলাব্যথা হলে অবহেলা না করে তাৎক্ষণিক সঠিক চিকিৎসা করলে বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়। তাই যেকোনো গলাব্যথায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। গলার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাতজ্বর হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।

বাতজ্বরজনিত হৃদ্‌রোগ

বাতজ্বর শনাক্ত করে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে না পারলে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি হার্টের সমস্যা। কিছুসংখ্যক রোগীর হার্টের ভালভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যার মধ্যে ভালভ সরু হয়ে যাওয়ার হার বেশি। সঠিকভাবে ভালভ বন্ধ হয় না, নষ্ট হয়ে যায় ভালভের কার্যকারিতা। একেই বলা হয় বাতজ্বরজনিত হৃদ্‌রোগ। এ কারণে রোগীর শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়, কাশি অথবা কাশির সঙ্গে রক্ত এবং পানি জমার কারণে ফুলে যেতে পারে পা। অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে রোগী, কমে যায় কর্মক্ষমতা। হার্টের ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। অনেক সময় হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হয়। অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের কারণে হার্টের ভেতরের জমাটবাঁধা রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছে স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে।র

বাতজ্বরজনিত হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ

কারও বাতজ্বর শনাক্ত হলে অবশ্যই তাকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। পেনিসিলিন–জাতীয় ব্যাকটেরিয়ানিরোধী ওষুধ বাতজ্বরের চিকিৎসায় খুব কার্যকর। লক্ষণের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে ব্যথানাশক ওষুধও ব্যবহার করার দরকার পড়ে। রোগটি যাতে আবার না হয় এবং ভবিষ্যতে বাতজ্বরজনিত হৃদ্‌রোগ না হয়, তার জন্য দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিরোধ ব্যবস্থাস্বরূপ পেনিসিলিন–জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হয়। কার কত দিন ওষুধ চলবে, নির্ভর করে রোগী কোন বয়সে বাতজ্বরে ভুগছে, তার ওপর। দীর্ঘমেয়াদি এ চিকিৎসা গ্রহণে কারও অবহেলা করা উচিত নয়।

বাতজ্বরজনিত হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা

বাতজ্বর থেকে ইতিমধ্যে যাদের হার্টের ভালভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে রোগের তীব্রতার ওপর। উপসর্গ ও ইকোকার্ডিওগ্রাফি এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগের তীব্রতা নির্ণয় করতে হয়। একবার বাতজ্বরজনিত হৃদ্‌রোগ হয়ে গেলে সারা জীবনই রোগীকে চিকিৎসা এবং ফলোআপের মধ্যে থাকতে হবে। কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসাপদ্ধতিতে বিশেষ বেলুন ব্যবহার করে সরু ভালভ প্রসারিত করা যায়। কখনো অপারেশনের মাধ্যমে কৃত্রিম হার্টের ভালভ প্রতিস্থাপনের দরকার পড়ে। অপারেশনের পরও সারা জীবন ওষুধ খেতে হয়।

অনুলিখন: ডা. শরদিন্দু শেখর রায়