আমাদের মস্তিষ্কেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব বেশি, সুরক্ষিত থাকতে কী করবেন

প্রতিদিনের জীবনযাপনে নানাভাবে আমরা প্লাস্টিক ব্যাবহার করি। জামাকাপড়, গাড়ি, মুঠোফোন, পানির বোতল, খাবারের প্যাকেট—সবকিছুতেই প্লাস্টিক আছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মস্তিষ্কেও আছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। নতুন পাওয়া তথ্য অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। প্লাস্টিকের এই ছোট ছোট কণা আমাদের শরীরের জন্য কতটা মারাত্মক?

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিক খুঁজে পেয়েছেন। যদিও অন্য বিজ্ঞানীরা এখনো এই গবেষণা ভালোভাবে যাচাই করেননি, তবে গণমাধ্যমে এটিকে উদ্বেগজনক বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু এই মাইক্রোপ্লাস্টিক আদতে কী? এসব আমাদের দেহের কী ক্ষতি করতে পারে? আমাদের কি এই মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিত?

মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রোগটি মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের ভেতর স্নায়ুরজ্জুকে আক্রমণ করে
ছবি: পেক্সেলস

মাইক্রোপ্লাস্টিক কী

আমরা নানান ধরনের প্লাস্টিক নিয়মিত ব্যবহার করি। ধরুন, একটা প্লাস্টিকের পানির বোতল। পানি খাওয়ার পর এই বোতল আমরা ফেলে দিই। আমরা জানি এবং সত্য যে প্লাস্টিক সহজে নষ্ট হয় না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক ভেঙে ছোট ছোট কণায় পরিণত হয়। সাধারণত পাঁচ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট প্লাস্টিকের কণাকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। এসব এত ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখাও যায় না।

মাইক্রোপ্লাস্টিক কী ক্ষতি করে

পানির নানা উৎস আর প্রতিদিনের খাবারেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। অর্থাৎ আমরা প্রতিনিয়ত খাবারের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করছি। এভাবে দীর্ঘদিন দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। যদিও মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরের কী কী ক্ষতি করতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা এখনো অনেক কম। তবে প্রতিনিয়ত এসব বিষয়ে গবেষণা বাড়ছে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক সম্পর্কে বিস্ময়কর তথ্য

এবার আসা যাক নতুন গবেষণার বিষয়ে। নিউ মেক্সিকোর আলবুকার্কি শহরের রুটিন পরীক্ষা–নিরীক্ষার সময় ৫১ জন নারী-পুরুষের লিভার, কিডনি ও মস্তিষ্কের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আগেই বলেছি, মাইক্রোপ্লাস্টিক অতিক্ষুদ্র হওয়ায় মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখাও কঠিন হয়ে যায়। তাই বিজ্ঞানীরা এসব দেখার চেষ্টাই করেননি। বরং জটিল যন্ত্র ব্যবহার করে নমুনায় থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিকের রাসায়নিক গঠন শনাক্ত করেছেন। আর সেই রাসায়নিক গঠন থেকে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, লিভার ও কিডনির তুলনায় মস্তিষ্কের নমুনায় ৩০ গুণ বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে!

আরও পড়ুন

মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিক বেশি কেন

বিজ্ঞানীদের ধারণা, মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বেশি বলে রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পৌঁছাতে পারে। পাশাপাশি লিভার ও কিডনি হয়তো এসব ক্ষতিকর কণা দেহের বাইরে বর্জ্য হিসেবে বের করে দিতে পারে, কিন্তু মস্তিষ্ক পারে না। এ ছাড়া মস্তিষ্কের কোষগুলো অনেক ধীরে বদলায়। তাই হয়তো মাইক্রোপ্লাস্টিক একবার মস্তিষ্কে ঢুকে গেলে সেখানে জমা হয়ে থাকে।

 গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মস্তিষ্কের নমুনায় প্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পরিবেশে প্লাস্টিক যত বাড়ছে, আমাদের শরীরেও তত বেশি ঢুকছে। গবেষণায় পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের বেশির ভাগ পলিথিন দিয়ে তৈরি। বোতলের মুখ বা বাজারের ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এই পলিথিন।

কীভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক মস্তিষ্কে পৌঁছায়

সাধারণত দূষিত খাবার, পানি ও বাতাসের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এসব প্রথমে পেটে বা ফুসফুসে যায়। সেখান থেকে রক্তে মিশে শরীরের নানা অঙ্গে পৌঁছায়। এতে আমাদের পেটের ভেতরের উপকারী জীবাণুদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হতে পারে। এ কারণে সৃষ্টি হতে পারে প্রদাহ। পাশাপাশি বাতাস থেকেও শ্বাসের মধ্যমে শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করতে পারে। আগের গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মল, লিভার, প্রজনন অঙ্গ, রক্ত, রক্তনালি ও হৃৎপিণ্ডে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।

শুধু মানুষই নয়, প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের মস্তিষ্কেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। ইঁদুরের ওপর করা গবেষণায় দেখা গেছে, খাবারের সঙ্গে নেওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিক পেট থেকে রক্তে মেশে এবং মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে। মস্তিষ্কে যাওয়ার সময় অন্যান্য অঙ্গেও জমা হতে পারে।

আরও পড়ুন

মাইক্রোপ্লাস্টিক কতটা দুশ্চিন্তার কারণ

আমরা এখনো জানি না মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরের ঠিক কতটা ক্ষতি করছে। তবে এটা পরিষ্কার, শরীরে একবার ঢুকে গেলে সেসব আর সহজে বের হয় না। কারণ, এদের ধরা অনেক কঠিন। আকারে খুব ছোট, গঠনেও আলাদা। একটা প্লাস্টিক ঠিক আরেকটার মতো নয়। গবেষণাগারের কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক মস্তিষ্কের প্রদাহ ও কোষের ক্ষতি বাড়াতে পারে। জিনের কার্যকারিতা পরিবর্তন করতে পারে এবং বদলে দিতে পারে মস্তিষ্কের গঠন। আবার মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণাগুলো যদি পরিবেশের বিষাক্ত জিনিস বা ব্যাকটেরিয়া বহন করে শরীরের ভেতরে নিয়ে যায়, তাহলেও ঝুঁকি থাকতে পারে। বিভিন্ন প্লাস্টিকের রাসায়নিক পদার্থও মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বেরিয়ে শরীরে মিশে যেতে পারে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বাঁচার উপায় কী

মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে এবং এর সংস্পর্শ এড়ানো কঠিন। মাইক্রোপ্লাস্টিক কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে, তা আমরা সবেমাত্র বুঝতে শুরু করেছি। যতক্ষণ না আমাদের কাছে আরও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আসছে, ততক্ষণ এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন। তবে এতটুকু জোর দিয়ে বলা যায় যে আমরা প্লাস্টিক যত কম ব্যবহার করব, আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তত কমবে। সহজ উপায় হলো, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের প্যাকেজে থাকা খাবার, পানীয় ও প্লাস্টিকের পাত্রে গরম করা খাবার এড়িয়ে চলা। আমরা আমাদের বাড়ি ও কাপড়ে সিনথেটিক ফাইবারের ব্যবহারও কমাতে পারি। প্লাস্টিকের বোতলের পরিবর্তে আমরা কাচের গ্লাস ব্যবহার করতে পারি। প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমালে ভবিষ্যতে হয়তো বড় বিপদ থেকে বাঁচা যাবে।

সূত্র: দ্য কনভারসেশন

আরও পড়ুন